সে আছে পাশে -ইশরাত শিউলি

17 Apr 2024, 02:13 PM গল্প শেয়ার:
সে আছে পাশে -ইশরাত শিউলি

আমি চন্দ্রাবতী! বাংলাদেশের মেয়ে! ঢাকায় থাকি ! বয়েস চল্লিশ পেরিয়েছি কিন্তু আমার শিশুসুলভ সারল্য এখনো আমাকে ছেড়ে যায়নি ! এই কংক্রিটের শহরে প্রাণের সন্ধানে ঘুরে বেড়াই ! কাজলদা’র সেই গানটার মতো ! আমি ঘুরিয়া ঘুরিয়া সন্ধান করিয়া স্বপ্নের ও পাখি ধরতে চাই আমার স্বপ্নের কথা বলতে চাই !

কাজল চৌধুরী ! আমার কিশোরী বেলার স্বপ্নের ফেরিওয়ালা ! অগোচরে আমার ভেতর স্বপ্নের বীজ বুনে দিয়েছিলেন ! শুধু আমি নই আমাদের প্রজন্মের অনেকের মধ্যে এখনো তার প্রভাব বিদ্যমান ! সে আমাদের মধ্য থেকে হারিয়ে গেছে বহুদিন হলো কিন্তু তার স্বপ্নেরা এখনো বেঁচে আছে!

ধূসর এই পৃথিবীতে এখনো যারা গান গায়, কবিতা লেখে, মানুষের অধিকারের জন্য লড়াই করে, পৃথিবীকে সুস্থ রাখার জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দেয়, এরা সবাই কাজলদা’র প্রতিনিধি ! কাজল এক চেতনার নাম, ভালোবাসার নাম ! সুন্দরের সঙ্গে বেঁচে থাকার নাম !

কাজলদাকে আমি প্রথম দেখেছিলাম আমার কিশোরী বেলার এক ফেব্রুয়ারি মাসে ছায়ানট প্রাঙ্গণে ! এখানে আমরা নজরুলসংগীত ও ক্লাসিক্যাল শিখতাম ! কাজলদা পঞ্চম বর্ষে, আমি দ্বিতীয় ! তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগে পড়ছেন আর আমি স্কুলছাত্রী ! প্রায়ই তাকে দেখতাম ক’জন ছেলেমেয়ে নিয়ে ছায়ানটের লম্বা বারান্দায় আড্ডা দিতে ! ডাকাতের মতো বড়ো বড়ো গোঁফ, কোঁকড়ানো ঝাঁকড়া চুল, রোগা শ্যামলা, স্বপ্নমাখা দু’টি চোখ, সব মিলিয়ে দীপ্তিময় যুবক ! প্রথম যেদিন দেখেছিলাম আমার মনে হয়েছিল তিনি সবার থেকে আলাদা ! খুব ইচ্ছে হতো কথা বলতে কিন্তু অপরিচিত মানুষের সঙ্গে কথা বলার সাহস তখনো রপ্ত করতে পারিনি, এই জন্যে কথা বলাটা হয়ে উঠত না !

একদিন ক্লাশ শেষে বারান্দার আড্ডায় তার সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলো আমাদের ক্লাসের একজন শিক্ষার্থী, অপুদা ! সে চারুকলার ছাত্র কাজলদার সহযোদ্ধা ! তারা তখন লম্বা বারান্দায় হাসি ঠাট্টা করছিল আমি পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম অপুদা গলা উঁচিয়ে ডাক দিলো- এই চন্দ্রা, এদিকে আসো তো। আমি একটু অস্বস্তি নিয়ে তাদের সামনে চলে এলাম। অপুদা বলল, কাজলদা এ হলো চন্দ্রা, খুব ট্যালেন্টেড মেয়ে। আমার অস্বস্তি আরেকটু বেড়ে গেল, আমি কারো দিকে তাকাতে পারছি না। কাজলদা কী বুঝেছিলেন জানি না। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, বালিকা তুমি কোন ক্লাসে পড়ো ? ক্লাস সেভেন ! কাজলদা চুল ঝাকুনি দিয়ে বললেন, অনেক বড়ো হয়ে গেছ ! তুমি বই পড়ো ? মাথা নেড়ে বললাম, হ্যাঁ! কী বই পড়ো তুমি ? কিশোর থ্রিলার তিনগোয়েন্দা ! বেশি বেশি করে বই পড়বা বুঝলা ? আমি আবার মাথা ঝাঁকালাম! তার সঙ্গে কথা বলার সময় অস্বস্তি কোথায় চলে গেল ! মনে হচ্ছে তিনি আমার অনেক দিনের চেনা ! কবিতা পড়ো ? হ্যাঁ ! একটা আবৃত্তি কর তো ! আমি এবছর স্কুলের আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিলাম, কাজলদা বলার সাথে সাথে আমি আবৃত্তি শুরু করলাম... ‘আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেল শেষে। হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে’ ! পুরো কবিতাটি সবাই মনোযোগ দিয়ে শুনল। শেষ হলে সবাই হাততালি দিলো। কাজলদা উৎসাহিত হয়ে বলল, বাহ্ তুমি অনেক ভালো আবৃত্তি কর তো ! আমার গালে হাত রেখে বললেন, তুমি আরো বেশি করে কবিতার চর্চা করবা কেমন ? আমি আবার মাথা ঝাঁকালাম ! অপুদা বললেন, কাজলদা চলেন, চারুকলায় যেতে হবে, পোস্টারগুলো লেখা হয়ে গেছে, ওগুলো দেয়ালে সাঁটাতে হবে ! হ্যাঁ, চলো চলো আমাকে বিদায় জানিয়ে কথা বলতে বলতে দলবল নিয়ে তিনি বেরিয়ে গেলেন ! আমি সেখানে দাঁড়িয়ে রইলাম, বাসা থেকে আমাকে নিতে আসবে তার অপেক্ষায় !

এরপর তার সঙ্গে প্রায়ই দেখা হতে লাগলো। দেখা হতেই মিষ্টি হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করতেন, বালিকা কেমন আছ ? তার সে হাসি আর চাহনিতে আমি কেমন যেন বিহ্বল হয়ে যেতাম। উত্তর দিতে পারতাম না ! এরই মধ্যে ছায়ানটের বাৎসরিক অনুষ্ঠানের গ্রুপ রিহার্সেল শুরু হলো। তখন থেকেই তার খুব কাছে চলে এলাম !

ছায়ানট হচ্ছে বাংলাদেশের বাঙালি সংস্কৃতির পীঠস্থান! পাকিস্তান আমল থেকে অনেক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে উঠেছে ! আমি যখনকার কথা বলছি তখন ছায়ানট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলে তাদের কার্যক্রম চালাত ! ছায়ানট কর্তৃপক্ষ প্রতিবছর ঘটা করে দু’টি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে, রমনার বটমূলে পয়লা বৈশাখের বর্ষবরণ আর একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাত ফেরি ! এবছরও তার ব্যতিক্রম নয় ! আমরা সদলবলে রিহার্সেল শুরু করলাম ! তুমুল সব প্রতিবাদী গান ! ‘হিমালয় থেকে সুন্দরবন হঠাৎ বাংলাদেশ কেঁপে কেঁপে ওঠে পদ্মার উচ্ছ্বাসে’, ‘ও আলোর পথযাত্রী এযে রাত্রি এখানে থেম না’, ‘কাইন্দ না কাইন্দনা মাগো বঙ্গ জননী’, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’ ? এই বিখ্যাত গানের অন্তরা আর সঞ্চারীর কথাগুলো অসাধারণ ! ‘সেদিনও এমন নীল গগনে বসনে শীতের শেষে, রাত জাগা চাঁদ চুমু খেয়েছিল হেসে’ ! এই কথাগুলো আমার কাছে একদম নতুন, ওয়াদুদ স্যার যখন তাঁর ভরাট কণ্ঠে সমস্ত দরদ ঢেলে দিয়ে গাইতেন আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যেতাম !

রিহার্সেলের ফাঁকে ফাঁকে চলতো দুষ্টুমি ! আমাদের সঙ্গে এক ভাইয়া ছিল ওনার নাম হিমালয় ইসলাম, তাকে দেখতে অনেকটা আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মতো ! হয়ত হেয়ার স্টাইলের জন্য ! তো সেই ভাইয়া নিজে গান লিখতেন, সুর করতেন, গাইতেনও। এই জন্যে তাকে সবাই গাতক বলে ডাকতাম। তিনি ছিলেন সহজ-সরল প্রকৃতির ! স্যার আপারা না থাকলে তিনি তার নিজের লেখা গান বেসুরো গলায় গাইতে শুরু করতেন। তার গলায় সুরের বড়ো অভাব। তিনি গাইতে শুরু করলেই সবাই তাকে নিয়ে মজা করতাম ! তিনি এসবে কিছু তো মনে করতেনই না বরং বেশি হাসাহাসি করলে জটাধরা শিবের মতো নৃত্য শুরু করে দিতেন ! সেকি পাগলা নাচ ! তার নাচ দেখে আমরা হেসেই কুটিকুটি ! আরেকজন ছিল ব্যান্ডসংগীতশিল্পী, সে দেখতে খুবই স্মার্ট ও সুদর্শন। মেয়েরা তার প্রতি সহজেই ক্রাশ খেত ! সে ছিল একটি বিখ্যাত ব্যান্ড দলের সদস্য। মেয়েরা তাকে ঠেলেঠুলে গান গাইতে পাঠাতো। তার ব্যান্ডের গান মানে হার্ডরক গাইতে গিয়ে যে চিৎকার সে দিতো তাতে সবার পিলে চমকে যেত ! সে গান গাইতে আরম্ভ করলেই স্যার আপারা সবাই রে রে করে দৌড়ে আসতেন চিৎকার থামাতে ! আমরা তার অবস্থা দেখে হো হো করে হেসে উঠতাম ! মজায় আনন্দে রিহার্সেল শেষ হলে, একদিন চলে এলো কাক্সিক্ষত একুশে ফেব্রুয়ারির দিন। আমরা ভাব গাম্ভীর্য বজায় রেখে, মেয়েরা সাদা-কালো শাড়ি আর ছেলেরা একই রঙের পাঞ্জাবি পরে প্রভাত ফেরি শেষ করে, ছায়ানটের গাড়িতে করে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে গিয়ে গান করতাম ! কাজলদা আমাদের নেতৃত্ব দিতেন !

তখন ৯০’র গণ-আন্দোলন তুঙ্গে ! স্বৈরাচার এরশাদ সরকার নির্লজ্জের মতো গদি আঁকড়ে বসে আছে ! দেশের মানুষের ইচ্ছে-অনিচ্ছের কোনো মূল্য নেই তার কাছে ! পাগলের মতো যা খুশি তাই করে বেড়াচ্ছে! তাকে হঠানোর জন্য দেশের সর্বস্তরের মানুষ তার বিরুদ্ধে পথে নেমেছে ! রাজনৈতিক দল, সাংস্কৃতিককর্মী, বিভিন্ন স্তরের পেশাজীবী মানুষ ! কিন্তু তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই ! কত যে নিঃস্বার্থ মেধাবী মানুষ মারা গেল এই আন্দোলনে এসে !

স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন দানা বেঁধেছিল ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ! হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদের ক্ষমতা দখলের দুই বছরের মাথায় ওই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি ছাত্র রাজনৈতিক দল মিলে ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ নামের একটি সংগঠন গঠন করে এবং তারাই প্রথম এরশাদ বিরোধী মিছিল করে রাস্তায় নামে ! বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তাঁদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায় ! মিছিলে নিহত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জাফর, জয়নাল, কাঞ্চন, দিপালি সাহাসহ আরো অনেকে। পরবর্তীসময়ে ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে শহিদ হন, ডা. মিলন, ছাত্র ইউনিয়নের রাজু, বুকে ও পিঠে স্বৈরাচার নিপাত যাক লিখে চির অমর হয়ে আছেন নূর হোসেন !

আমাদের কাজলদা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ! স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের অগ্র সৈনিক ! সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট দেশব্যাপী যে কর্মসূচি পালন করছে তিনি সেখানেও নেতৃত্ব দেন, ছায়ানট থেকে কয়েকজন ছেলেমেয়েকে নিয়ে তিনি একটি সাংস্কৃতিক দল গঠন করেছেন, টিএসসিতে বসে গান কবিতার চর্চা হয় ! এখানে এমন আরো অনেকগুলো দল আছে তারা সবাই মিলে একসঙ্গে রাস্তায়, খোলা মাঠে, প্রান্তরে গানে কবিতায় প্রতিবাদের ঝড় তোলে ! ইতোমধ্যে ৮৮ খ্রিষ্টাব্দে নেমে এল ভয়াল বন্যা ! মানুষ, ঘর-বাড়ি, গবাদি পশু ভেসে যাচ্ছে বন্যার পানিতে ! কাজলদা আমাদের নিয়ে বন্যার্তদের সাহায্যের জন্য মাঠে নেমে পড়লেন। একদিকে আন্দোলন আরেক দিকে বন্যার্তদের সাহায্যের জন্য অর্থ জোগাড় করা ! আমরা দলবেঁধে মানুষের দ্বারেদ্বারে ঘুরে পুরনো কাপড়, টাকা, চাল, ডাল চেয়ে এনে বন্যার্তদের জন্য পাঠাতে শুরু করলাম ! কাজের মাঝখানে কিছুটা সময় বের করে কাজলদা আমাদের নিয়ে পাঠচক্রে বসেন ! ছোটোদের রাজনীতি, ছোটোদের অর্থনীতি, যে গল্পের শেষ নেই এই বইগুলো নিয়ে আলোচনা করেন ! আমাদের রাশিয়ান লেখকদের বই পড়তে উৎসাহিত করেন ! নীলক্ষেতের রাস্তা ধরে যাওয়ার সময় ম্যাক্সিম গোর্কির মা, নিকলাই অস্ত্রভস্কির ইস্পাত, আমাদের জন্য কিনে আনতেন ! বই শুধু পড়লেই হবে না ! কে কতটা বুঝতে পেরেছি রীতিমতো পরীক্ষা নিতেন ! এভাবেই স্বপ্নের মতো দিনগুলো এগিয়ে যাচ্ছিল !

বন্যার পরে আন্দোলনের মাত্রা আরো বেড়ে গেল ! সরকারও বসে নেই, পুলিশ, সেনাবাহিনী তো আছেই। এছাড়া অভি, নিরু ও বাবলু নামের তিন গু-াকে লাগিয়েছে ছাত্রজনতাকে ভয় ভীতি দেখানোর জন্য ! তারা অতর্কিতে মিছিলে হামলা করে, বোমা মারে ! কাজলদা তার ক্ষুদে দলটাকে সবসময় চোখেচোখে রাখেন ! সন্ধ্যার আগে সবাইকে বাসায় পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেন ! আমাকে প্রায়ই নিজে পৌঁছে দেন ! আমরা সবাই কাজলদার সঙ্গে বাসায় যাওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকি। তার সঙ্গে যাওয়ার মজাই আলাদা ! রাস্তায় যেতে যেতে চলে গানের প্রতিযোগিতা। তিনি একটা গেয়ে শেষ করেন তো সঙ্গে সঙ্গে আমি আরেকটা ধরলাম ! অনেক পথ হেঁটে গেলেও সময় কোন দিক দিয়ে চলে যেত বুঝতেই পারতাম না ! এর মধ্যে ঘটে গেল এক ভয়ানক ঘটনা ! আমি টুপ করে তার প্রেমে পড়ে গেলাম ! আমার ছোট্টো জীবনের নতুন যন্ত্রণা ! কাজলদা ! সেতো লীনা আপার সঙ্গে... দূর থেকে তাদের দু’জনকে দেখি আর জ্বলে-পুড়ে মরি ! মনে মনে ভাবি, আমি কবে লীনা আপার মতো বড়ো হবো ? আমার অকারণে কান্না পায় ! লীনা আপার কী সুন্দর সিল্কি চুল, কাজল দেওয়া বড়ো বড়ো চোখ ! শাড়ি পরলে তাকে ঠিক বনলতা সেনের মতো দেখতে লাগে ! এতদিনে আমার জীবনানন্দ দাশ পড়া শেষ ! গোপনে সৈয়দ শামসুল হকের ‘খেলা রাম খেলে যা’ পড়ে ফেলেছি, ন’হন্যতে, লা নুই বেঙ্গলি সব নতুন নতুন বই পড়ি আর মনের নতুন নতুন দ্বার খুলে যায় ! আমি মোটামুটি সবকিছু বুঝতে শিখে গেছি কিন্তু ভীষণ অন্তর্মুখী, সব বিষয় প্রকাশ করার ক্ষমতা আমার হয়নি ! কাজলদা কি বুঝতে পারতেন আমাকে ? তখন আমার পক্ষে বোঝা কঠিন ছিল ! সবার সঙ্গে তার সমান সখ্য ! এত কাজের চাপেও একদিন হঠাৎ আমার লেখাপড়ার বিষয়ে খোঁজ নিতে শুরু করলেন ! লেখাপড়ার অবস্থা তো খুবই খারাপ ! স্কুল বন্ধ ! কোচিং-এর নাম করে এখানে চলে আসি ! বাসায় পড়ার বইয়ের ভেতরে নভেল রেখে পড়ি ! বাকি সময়টুকু কাজলদার ভাবনায় বিভোর থাকি ! তিনি কি কিছু বুঝতে পেরেছেন ? জানি না !

একদিন আমাকে ভালোভাবে পাকড়াও করলেন ! শাহবাগে সিলভানা নামের একটি রেস্তোরাঁ ছিল আমাকে নিয়ে গিয়ে সেখানে বসলেন ! আমার দিকে এমনভাবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন, আমার মনে হলো আমার ভেতরটা তিনি দেখতে পাচ্ছেন ! আমি কোথায় পালাবো ? বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করছে ! কী মনে করে আমার ডান হাতটা টেনে নিলেন। আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল ! হাতের রেখা পরখ করতে করতে বললেন, লেখাপড়া তো শিকায় উঠেছে ? আমি তো অবাক, মনে মনে বলি, জানলো কী করে ? কাজলদা আস্তে করে বললেন, বুঝলাম কী করে ? হাতের রেখায় লেখা আছে ! তোর মনটা শুধু আকাশে বাতাসে উড়ে বেড়ায়, না রে ? এরপর বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বললেন, হহমম মনটাকে হাতের মুঠোতে আনতে হবে বুঝলি ? কীভাবে মন হাতের মুঠায় আনতে হয় জানিস ? আমি মাথা দোলালাম, নাহ ! শিখিয়ে দিবোনে, আজ সময় নাই, পরে শিখাব ঠিক আছে ? আমি আবার মাথা নাড়লাম ! শোন, আসল কথায় আসি, আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম আসল কথা শোনার জন্য! এরপর তিনি পড়াশোনার গুরুত্ব বিষয়ে লম্বা বক্তৃতা দিলেন ! তার সেদিনের বক্তৃতাখানি আমার মনে গেঁথে গিয়েছিল ! আশা করেছিলাম আমার মনের ভাব যেহেতু তিনি বুঝতে পেরেছেন প্রেমবিষয়ক দুয়েকটা বাণীও হয়তো ঝরবে, বিধিবাম এই সংক্রান্ত কোনো কথাই বললেন না ! কয়েক পদের খাবার অর্ডার দেওয়া হয়েছিল, আমরা কিছুই খেলাম না, সেখান থেকে উঠলাম।

সেদিনের বক্তৃতা মন্ত্রের মতো কাজ করেছিল। আমি লক্ষ্মী মেয়ের মতো পাঠ্য বইয়ে মনোযোগ দিয়েছিলাম! একবেলা কোচিং করে টিএসসিতে চলে আসি, কাজলদা’কে খুঁজে পেতে বেগ পেতে হয় না, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উল্টোদিকের গেট দিয়ে ঢুকে টিএসসির ছোটো বারান্দায় তিনি দলবল নিয়ে রিহার্সেল করেন। বাক্য ব্যয় না করে আমিও সেখানে বসে পড়ি, কিছুক্ষণ গলা ফাটিয়ে রিহার্সেল করে সবাই মিলে পিকেটিঙের জন্য রাস্তায় নেমে যাই ! কোরাসে গান গাইতে গাইতে শাহবাগের মোড়ে এসে শুরু হয় আমাদের আসল কাজ ! সামনে রিকশা এলে যাত্রী নামিয়ে চাকার হাওয়া ছেড়ে দিই ! ভুলক্রমে প্রাইভেট গাড়ি এসে পড়লে তো কথাই নেই, চলন্ত গাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি, গাড়িটি থেমে গেলে যাত্রীর উদ্দেশ্যে গরম বক্তৃতা ঝাড়া শুরু হয়। মালিককে নামিয়ে গাড়ি উল্টো দিকে পাঠিয়ে দেওয়া হতো। কখনো কখনো আবার ইট পাটকেল ছুড়ে গাড়ি ভাংচুর করা হতো- এই কাজটি করতে আমরা খুব মজা পাই ! এই কর্মকা-গুলো যারা করছি তাদের মধ্যে আমি সর্বকনিষ্ঠ ! মাঝে মাঝে বিশাল মিছিল নিয়ে ঢাকার রাস্তা দাপিয়ে বেড়ায় সাংস্কৃতিক কর্মীরা ! সেই মিছিলে দ্রুম দ্রুম করে গুলি ছুটে আসে নয়ত বোমা ! মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় কিন্তু কাজলদা আমাদের হাত ছাড়ে না ! সেইসব আন্দোলনে আমাদের নেতৃত্ব দিতেন ম হামিদ ভাই, হাসান আরিফ, গোলাম কুদ্দুস, কাজলদাসহ আরো অনেকে ! তখন টিভি তারকা হিসেবে শমী মিমিদের যুগ, শমী কায়সারের খুব ক্রেজ। সে আবার শহিদ বুদ্ধিজীবী শহিদুল্লাহ কায়সারের কন্যা ! তো সে একদিন চড়া মেকআপ লাগিয়ে মঞ্চে এসে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিলো! পছন্দের অভিনেত্রীকে কাছে পেয়ে জনতা আরও বেশি উজ্জীবিত হয়ে উঠেছিল! এভাবেই গণআন্দোলনের বেগ বাড়তে থাকে!

একদিকে আমাদের বিক্ষোভ অন্য দিকে চলছে ছাত্রদের মধ্যে গোলাগুলি ! এরশাদের জাতীয় পার্টির ছাত্র সংগঠন ছাত্র সমাজ বনাম জাসদ ছাত্রলীগ ছাত্রদল আওয়ামী ছাত্রলীগ ঠা ঠা ঠা সম্মুখ যুদ্ধ! একদিন তো আমি দুই পক্ষের গোলাগুলির মধ্যে পড়ে গেলাম! দ্রুত মধুর ক্যান্টিনের দিকে যাচ্ছিলাম ওখান থেকে আজকের সম্মিলিত মিছিল বের হওয়ার কথা, আমার কোচিং থেকে বেরুতে দেরি হয়ে গেছে এইজন্যে তাড়াহুড়া! ডাকসুর সামনে আসতেই গোলাগুলির আওয়াজ ! আমি চোখ বন্ধ করে দৌড় দিতে গিয়ে দেখি আইবিএ ভবন থেকে আরেক দল গুলি ছুড়তে ছুড়তে সামনের দিকে আসছে, আমি পড়ি মাইঙ্কার চিপায়, কী করব ? দিশেহারা অবস্থা- হঠাৎ অনুভব করলাম কেউ আমাকে পাঁজাকোলা করে দৌড়াচ্ছে, চোখ মেলে দেখি যে, আমাকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে যাচ্ছে তার হাতেও বন্দুক, আমি পুরাই বাক রুদ্ধ! বেশ কিছুক্ষণ আমাকে নিয়ে দৌড়ানোর পর সে আমাকে চারুকলার দিকে ছুড়ে মারল! আমি সেখানে কালক্ষেপণ না করে চারুকলার ভেতর দিয়ে শাহবাগ এসে উঠলাম! আমার মাথা ঝিমঝিম করছে একটু আগের ঘটে যাওয়া ঘটনাটি এখন স্বপ্নের মতো লাগছে ! এযাত্রায় বেঁচে গেছি ! জায়গামতো একটা গুলি এসে লাগলে এখন কোথায় থাকতাম আমি ? আর ভাবতে পারছি না ! ঘোরের মধ্যে শাহবাগের মোড়ে এসে দেখি সেখানে কিছু মানুষ জটলা করছে। তাদের মধ্যে দুয়েকজন পরিচিত মুখও আছে। আমি কাউকে কিছু না বলে সোজা বাসার দিকে হাঁটা ধরলাম! বাসায় এসে খুব স্বাভাবিকভাবে খেয়েদেয়ে পড়তে বসলাম ! আম্মা, নানু কেউ বুঝতেই পারল না আজ আমার কতবড়ো একটা ফাঁড়া কেটে গেছে !

ওই ঘটনাটি এখনো আমার মনে দাগ কেটে আছে ! আচ্ছা আমি কি সেদিন ভয় পেয়েছিলাম ? আমার যতটুকু মনে পড়ে একদমই না ! একধরনের রোমাঞ্চ বোধ কাজ করছিল ! ৯০-এর আন্দোলনের ঘটনাগুলো মনে হলে আমি এখনো রোমাঞ্চিত হই !

দেশব্যাপী জনগণের আন্দোলনের মুখে ও বিদেশি চাপে ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে স্বৈরাচার সরকার ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হলো ! এরশাদ ক্ষমতা ছাড়ার পরের দিন ঢাকা শহরজুড়ে আনন্দ মিছিল বের হয়েছিল আমিও সেই মিছিলে অংশগ্রহণ করেছিলাম!

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দেশ চলছে, ঢাকা শহর এখন অনেকটাই শান্ত, মানুষ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেছে ! সামনে নির্বাচন ! স্কুল কলেজ খুলে গেছে। আমরা লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। বিপ্লব আপাতত সমাপ্ত ! এখন শুধু সপ্তাহে দু’দিন গানের স্কুলে যাই। এরই মধ্যে টিএসসির একটি আবৃত্তি গ্রুপে ভর্তি হয়েছি এখানেও দু’দিন ক্লাশ ! ছায়ানটের পর এখানে চলে আসি, আবৃত্তিচর্চা খুবই কঠিন কাজ ! এই কঠিন কাজটিকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি ! স্বৈরাচার পতনের পর বাংলা একাডেমি নব সাজে বইমেলার আয়োজন করেছে। এবারের বইমেলায় বইয়ের পাশাপাশি আবৃত্তির ক্যাসেটের স্টল বসেছে। স্টলগুলোয় আন্দোলনকারী আবৃত্তিকারদের কবিতায় সয়লাব ! এখানে আমারও একটি ডুয়েট কবিতার অ্যালবাম বেরিয়েছে কথোপকথন ধরনের, অল্প বয়েসিদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় হয়েছে আমাদের অ্যালবাম ! কবিতার কথা সবার মুখে মুখে ফেরে ! আমি স্টলে বসলে শ্রোতারা আমাকে দেখতে আসে অটোগ্রাফ চায়, কী যে মজায় কাটছে দিনগুলো ! এরমধ্যে আমাদের আবৃত্তি দল থেকে কয়েকটি মঞ্চ প্রযোজনা করা হলো ! পাবলিক লাইব্রেরি মঞ্চে ‘রাজা ইডিপাস’ নিয়ে কাজ করলাম। এই কাব্যগ্রন্থটি আত্মস্থও করতে গিয়ে ইডিপাস কমপ্লেক্স সম্পর্কে আমাদের ধারণা হলো। ফ্রয়েডের দর্শন নিয়ে প্রচুর আলাপচারিতার ফলে এই বয়সেই আমি দার্শনিক চিন্তার সাথে পরিচিত হলাম ! এরপর রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহর কবিতা সমগ্র নিয়ে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে মঞ্চায়ন হলো ‘মানুষের মানচিত্র’। এখানে আমি রুদ্রের বেশ কয়েকটি কবিতা আবৃত্তি করলাম। মহিলা সমিতি মঞ্চে রবীন্দ্রনাথের কবিতা। এছাড়া প্রায় নিত্যদিন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমাদের কবিতার দলের পারফর্মেন্স থাকে ! চুপি-চুপি বলে রাখি, সেই সময়টাতে আমি কয়েকটি মঞ্চ নাটকেও অভিনয় করেছিলাম ! সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাব্যনাট্যে নন্দন কাননে দ্রোপদী নাটকের দ্রৌপদী এবং এই সময়ের খ্যাতিমান পরিচালক গাজি রাকায়াতের নির্দেশনায় একটি নাটকে নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম ! সেখানে আমার সহ-অভিনেতা ছিলেন শহিদুল আলম সাচ্চু ভাই, আঁকিয়ে টুটুল, হ্যাপি ! সবচেয়ে মিষ্টি ছিলেন সাচ্চু ভাইয়ের স্ত্রী কনা ভাবি, খুব সরল আর ভালো একজন মানুষ !

এসব কর্মযজ্ঞের মধ্যে কখনো সখনো কাজলদা’র সঙ্গে দেখা হয়, আমার কাজ-কার্মে তিনি খুবই খুশি! বাড়ি যাওয়ার পথে সামনে পড়ে গেলে সাথে করে নিয়ে পৌঁছে দেন ! তার সঙ্গে যাওয়ার পথে সময় কোথায় উড়ে চলে যায় বুঝতে পারি না আমি ! তিনি বাসায় ছেড়ে যাওয়ার পর বুকের মধ্যে একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হয়, যে ব্যথা আমি এখনো বহন করে চলেছি !

সামনে এসএসসি পরীক্ষা। পড়াশোনায় মনোযোগ দিলাম। বাড়ি থেকে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে- বাড়ির বাইরে পা ফেলা যাবে না। মুখ বুজে লেখাপড়া করি, সময় বের করে ঘরে বসে কণ্ঠচর্চা করি ! এই করেই দিন চলে যায় ! কাজলদার সঙ্গে দেখা হয় না। তবে শুনতে পাই তিনি একটি খবরের কাগজে চাকরি করছেন। মাঝে মধ্যে টেলিফোনে কথা হয় ! তখন তো মোবাইলের যুগ ছিলো না টিএনটি ভরসা !

পড়াশোনা খতম করে এনজিওতে জয়েন করেছি আর ভয়েজ ওভারের কাজ করি ! বিদেশি সিনেমা ও অ্যাডের পেছনে কণ্ঠ দিই- তখনো ভয়েজ ওভার বাংলাদেশে পরিচিতি পায়নি !

কাজলদার সঙ্গে দেখা হয় না বহু দিন ! তিনি একদিন আমার এনজিওর অফিসে ফোন করে বললেন, আমার অফিসে চলে এসো ! তিনি তখন একটি জনপ্রিয় কাগজের ফিচার বিভাগের দায়িত্বে আছেন ! মন স্থির করলাম যাব, তার সঙ্গে দেখা করতে !

পত্রিকা অফিসের তিনতলায় উঠে দেখি লম্বা রুমের শেষ মাথায় একদঙ্গল ছেলেমেয়ে কিচিরমিচির করছেন ! তিনি মূর্তিমান মাঝখানে বসা। আমার দিকে চোখ পড়তেই সামনে এগিয়ে এলেন ! আমার বুকের মধ্যে তখন বৈশাখি হাওয়া বইছে ! তার প্রথম কথা, এরে বাবা এ কে ? তুমি এত বড়ো হয়ে গেছ ? কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে থেকে অস্ফুটে বললেন, তুমি এত সুন্দর হয়ে গেছ ! তারপর বললেন, গুটিপোকা থেকে প্রজাপতি পাখা মেলেছে দেখ ! তাঁর কথায় আমি লজ্জা পেয়ে গেলাম- তার মুখে এর আগে এরকম কথা শুনিনি। সবসময় আমাকে বাচ্চা মেয়ে হিসেবে ট্রিট করতে দেখেছি ! আমার মনোভাব বুঝতে পেরে চুপ মেরে গেলেন ! অন্য ছেলেমেয়েরা আমার দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকাচ্ছে। কাজলদা সবার সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। ওখানে যে মেয়েটি সবচাইতে বেশি খলবল করছিল তার নাম নবনীতা চৌধুরী, সম্পর্কে কাজলদার ভাতিজি, আপন নয়, একটু দূরের ! তার পাশে তাজিন, সে লেখালেখির পাশাপাশি থিয়েটারে অভিনয় করে, টেলিভিশনেও দুয়েকটা নাটক করেছে, পরিচিত মুখ ! মোটা মতো একটা ছেলে ওর নাম সুমন, দেখতে সুদর্শন, ছেলেটির নাম শামিম তার পাশে আরিফ এছাড়া আরো কয়েকজন ছিল ! প্রথম পরিচয় হলেও সবার সঙ্গে আড্ডাটা ভালোই জমেছিল, সে এক অন্যরকম আড্ডা। এখানে প্রাণ খুলে কথা বলা যায় ! আড্ডা সমাপ্ত হলে কাজলদা তার টিম মেম্বারদের সাথে পরবর্তীসংখ্যা নিয়ে আলোচনা শুরু করলেন ! সবাইকে নির্দিষ্ট করে অ্যাসাইনমেন্ট ভাগ করে দিলেন ! আমি ভয়েজ ওভারে কাজ করি শুনে প্রথম দিনই আমাকে ডাবিং নিয়ে একটি লেখা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন ! মিটিং শেষ হলে সবাইকে বিদায় জানিয়ে আমি আর কাজলদা বেরিয়ে পড়লাম ! পুরনো দিনের মতো হাঁটতে শুরু করলাম, সেইসব দিনের স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে পরিবাগ থেকে হেঁটে শাহবাগ আজিজ মার্কেটে এসে পাঠক সমাবেশে ঢুকলাম, সেখানে কিছুক্ষণ বই নাড়াচাড়া করে সেখান থেকে বেরিয়ে ঘণ্টা চুক্তি হিসেবে রিকশা ভাড়া করলাম দু’জনে মিলে ঘুরে বেড়াবার জন্যে ! রিকশায় বসে কাজলদার সেই চিরচেনা গান কতদিন পর ...! তিনি গাইছেন, ‘শুনো গো দক্ষিণো হাওয়া প্রেম করেছি আমি ...।’ আমি যেন স্বপ্নের শাওরে ভাসছি ! আমার ভেতরটা উথাল-পাথাল করছে, আমি দ্বিতীয়বারের মতো তার প্রেমে পড়ে গেলাম ! একসময় রিকশা ভ্রমণ শেষ হলো। আমাকে বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে তিনি সেই রিকশায় চলে গেলেন ! কাজলদা চলে গেলেন কিন্তু তার সুর আমার রক্তের মধ্যে বেজে চলেছে, ‘শুনো গো দক্ষিণো হাওয়া...।’

তখনো ব্যাঙের ছাতার মতো টিভি চ্যানেল গড়ে ওঠেনি। সন্ধ্যার পর ঘরে বসে সময় কাটানোর জন্য বাংলাদেশ টেলিভিশন একমাত্র বিনোদন-মাধ্যম ! সেই সময় বিটিভির নাটক খুবই জনপ্রিয় ছিল। নাটক বানাতে খরচ বেশি তাই চ্যানেল কর্তৃপক্ষ বাংলায় ডাবিং করা বিদেশি সিরিয়াল প্রচার করতে শুরু করেছে ! ইরানিয়ান কালচারাল সেন্টার তাদের দেশের সিরিয়াল বাংলায় ডাবিং করে বিটিভিতে প্রচার করছে, আমরা একঝাক ডাবিংশিল্পী সেখানে কণ্ঠ দিই ! আমি সবার ইন্টারভিউ নিয়ে একটি ফিচার তৈরি করলাম ! এক বিকালে চলে গেলাম পত্রিকা অফিসে যথারীতি কাজলদা তার কিচিরমিচির বাহিনী নিয়ে বসে আছেন, তার সামনে গিয়ে লেখাটা দিলাম। তিনি লেখাটা টেবিলের ড্রয়ারে রেখে আমাকে পাশে বসালেন ! আজকের আড্ডার বিষয় লেখার মান বাড়ানো প্রসঙ্গে কাজলদা বলছেন, আমরা সকলে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছি, পড়ার জন্য কিছু বই সাজেস্ট করলেন ! তার মাস্টারি করার ধরনটাও মজার ! হাসি-ঠাট্টার মধ্যেও যে শিক্ষা দান করা যায় তার উদাহারণ স্বয়ং কাজলদা !

পাঠদান শেষ হলে শুরু হলো তুমুল আড্ডা ! সবার কথায় কান ঝালাপালা হওয়ার জোগাড়। আরিফ আর বিপুল সমানে আমাকে লেগপুল করছে। তিনি পাসে বসে মিটিমিটি হাসছেন ! নতুন একটা বন্ধু সারকেল পেয়ে আমার খুব আনন্দ হচ্ছে ! এই ছেলেমেয়েগুলো আমার দেখা পৃথিবী থেকে একদম আলাদা ধাঁচের ! সবার মধ্যে একটা ড্যাম কেয়ার ভাব আছে। আমি তো একটু নুতুপুতু ধরনের ওদের সামনে পেলে আমার আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায় ! সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতেই একে একে সবাই বিদায় নিলো ! আমি আর কাজলদা মুখোমুখি বসে আছি, দু’জনেই নির্বাক ! ফিচার বিভাগের সবাই মাথা গুঁজে বসে আছে- কাজ নিয়ে ব্যস্ত ! আমার মনে হচ্ছে আমরা দু’জন একটি নির্জন দ্বীপে বসে আছি ! আমাকে চমকে দিয়ে কাজলদা হঠাৎ গান গেয়ে উঠলেন- ‘যে ক্ষতি আমি গিয়েছিলাম ভুলে সেই ক্ষতি পূরণ করতে কেন এলে...।’ আমি মনে মনে ভাবছি কে ক্ষতি করেছে কাজলদা’র, লীনা আপা ? তাহলে সে আমাকে... আর ভাবতে পারছি না বুকের মধ্যে ছলাৎ ছলাৎ করে উঠছে ! গান থামিয়ে বললেন, চলো তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিই !

রিকশায় আবার সেই ভুবন ভোলানো গান ! রাস্তার অবস্থা ভালো নয়, একটু পরপর রিকশা ঝাকি দিচ্ছে, রিকশার ঝাকুনিতে আমাদের দু’জনের শরীর কথা বলতে আরম্ভ করেছে ! আমি তার দিকে তাকাতে সাহস পাচ্ছি না আমার দৃষ্টি আমার কোলের উপর রাখা দুই হাতের দিকে নিবদ্ধ ! মনে মনে গান বাজছে, ‘একটুকু ছোঁয়া লাগে একটুকু কথা শুনি’... কাজলদা বললেন, গানটা কি একদম ছেড়ে দিয়েছ ? চর্চা নেই অনেক দিন, এত ভালো আবৃত্তি করতে ?! সবকিছু ছেড়েছুড়ে দিলে হবে ? আবার শুরু করো। আমি মাথা ঝাকালাম ! দৃক গ্যালারিতে এক্সিবিশন হচ্ছে এর ওপর একটা লেখা দাও আর সেতার বাদক সমির দাসের একটা ইন্টারভিউ করবে। এই দুটো অ্যাসাইনমেন্ট আগামী সপ্তাহের জন্য দিলাম, ঠিক আছে। মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম, ঠিক আছে। সেদিন এর বেশি আর কথা হলো না ! রিকশা থেকে নেমে আমি গেটের ভেতর ঢুকলাম, কাজলদা রিকশা ভাড়া মিটিয়ে হাঁটা ধরলেন। আমি কলাপসিবল গেটের ফাঁক দিয়ে তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম। অদ্ভুত ধরনের মায়া আমাকে গ্রাস করেছে। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে যেও না কাজলদা, প্লিজ আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাও ! নিজের অজান্তে দু’চোখ বেয়ে জলধারা ঝরছে সামাল দিতে পারছি না। দূর থেকে তিনি একবার পেছন ফিরে তাকালেন আমাকে দেখতে না পেয়ে আবার চলতে শুরু করলেন। মিলিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমি সেখানে দাঁড়িয়ে রইলাম !

অনেক দিন পেরিয়ে গেছে, এখন আমি একটি মিডিয়া হাউজে ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করছি ! কাজলদার সাথে সম্পর্কের কোনো উত্থান-পতন নেই। তবে একই জায়গায় থেমেও নেই। এখন অনেকটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক আমাদের ! কাজের পরে বন্ধুদের বাড়িতে আড্ডা হয়, একেকদিন একেক জনের বাসায়, কিঞ্চিৎ মদ্য পান এরপর শুরু হয় বাঙালির ইন্টেলেকচুয়াল ভাষণ ! কাজলদার অবশ্য আলাপে রুচি নেই, তিনি পান করেই আনন্দিত! নির্বিকারে বোতলের পর বোতল গলদকরণ করছেন ! এতদিনে আমি বুঝে গেছি, তিনি এলকহলিক ! খাঁটি জিনিস না পেলে স্প্রিটও গিলতে থাকেন ! একদিন ধরলাম তাকে, কেন কাজলদা এই আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন ? তার চোখে পানি চলে এলো। আসলেই জানতে চাস ? বুঝতে পারবি ? বুঝতে চেষ্টা করবো, তুমি বলো না ! তিনি বলতে লাগলেন সুন্দর একটা সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলাম জানিস ! স্বাধীন দেশে মানুষ কাক্সিক্ষত অধিকার বুঝে পাবে প্রতিটি শিশুর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত হবে ! কী হচ্ছে চারিদিকে ? নদী ভরাট করে ইমারত তৈরি হচ্ছে, প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস হচ্ছে ! ধনী আরো ধনী হচ্ছে ! দরিদ্র মানুষ রাস্তায় আকাশের নিচে বিছানায়... এসব নিতে পারি না। তাইতো নিজেকে ভুলিয়ে রাখতে... তুমি বোতল বোতল মদ গিলে বিপ্লব করে ফেলবা ? আজব ! মনটাকে কী করে হাতের মুঠোয় আনতে হয় তাতো তোমার মতো কেউ জানে না, তাই না ? এই তুমিই না আমাদের জ্ঞান বিতরণ করতা ? জীবনের গুরুত্ব বিষয়ে বক্তৃতা দিতা ? এসব কমপ্লেইন তোমার অজুহাত ! আসলে তোমাকে ধ্বংসের নেশায় পেয়েছে, তুমি নিজেকে শেষ করে দিতে চাও এটা তোমার একধরনের খেলা ! হয়ত তোর কথাই ঠিক ! লীনা আপা কোথায় ? সেতো কবেই বিয়ে করেছে, সুখেই আছে বোধ হয়, খবর জানি না, তার প্রসঙ্গ কেন ? আমি ভাবলাম তার বেদনায় দেবদাস হয়েছেন কি না ! আরে ওসব কিছু না ! আমি জোর দিয়ে বললাম, তোমার মদ ছাড়তে হবে ঠিক আছে ? ঠিক আছে ! প্রমিজ, আর খাবেন না ! প্রমিজ একদম খাব না!

সেদিনের পর থেকে তার আর দেখা নেই ! তিনি আমার কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বন্ধুদের আড্ডায় তাকে পাই না ! আমার অন্তর জ্বলে যায়, আমার দুই চোখ উৎসুক হয়ে আছে তাকে একপলক দেখার জন্যে ! আমার মগজের ভেতর কালিদাস বসে আছে প্রিয়ার বিরহে মেঘদূতের পঙ্ক্তিমালা আওড়ে যাচ্ছে মন্ত্রপাঠ পুরোহিতের মতো ! আজ তাকে ধরবই, সকাল থেকে তার টেবিলের সামনে বসে রইলাম ! দ্বিতীয় প্রহরে তিনি এলেন সঙ্গে একটি মেয়ে, মেয়েটি দেখতে বেশ ভালো ফরসা কাটাকাটা চেহারা, গালে চুলে রং করা পোশাক-আসাক কেতাদুরস্ত তার সব কিছুতে আলাদা একটা চটক আছে ! চলার গতি সাবলীল ! তাদের পারস্পারিক শারীরিক ভঙ্গি বলে দেয়, সম্পর্ক কতটা গভীর ! আমার ভেতরটা তীর বেঁধা বাঘিনির মতো ছটফট করছে, মনে হচ্ছে তাকে ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলি ! আমার সামনে এসে মেয়েটির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলো প্রিয়া ও হচ্ছে চন্দ্রাবতী। মেয়েটি হাত উঁচিয়ে সালাম দিলো। আমি একটু অস্বস্তিতে পড়লাম। সমবয়েসী কেউ সালাম আদান-প্রদান করে আমার জানা ছিল না। আমি ছোট্টো করে একটু হাসলাম ! চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, বালিকা তোমার দেখা নাই কেন ? খুব ব্যস্ত ? আমি চুপ মেরে আছি, কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না ! দেখো আমি কিন্তু আর ড্রিংক করছি না, তোমার কথা রেখেছি ! কাজলদা আমার কথা রেখেছেন আমার তো আনন্দিত হওয়া উচিত। ভেতরটা ছারখার হয়ে যাচ্ছে কেন ? সে কথা বলছে আমার সঙ্গে কিন্তু মেয়েটি প্রিয়া আকুল হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে ! কিচ্ছুটি না বলে আমি সেখান থেকে উঠে চলে এলাম !

রাস্তায় হাঁটছি, ঘোরের মধ্যে হেঁটে চলেছি কোথা থেকে কোথায় যাচ্ছি জানি না, চোখের পানিও শুকিয়ে গেছে একসময় ! আকাশ আর মাটি আলাদা করতে পারছি না ! বুকের মধ্যে চাপচাপ কষ্ট নিয়ে একসময় বাসায় ঢুকলাম ! আম্মা খাবার আগলে বসে আছে। এত দেরি করলি ? ‘যা হাত মুখ ধুইয়া আয়। খেয়ে নে !’ ‘আমি খেয়ে আসছি মা। কতদিন না বলছি, আমার জন্য বসে থাকবা না ?’ ‘তুই তো কিছু বলে যাস নাই তোর দেরি দেইখা টেনশনে আছিলাম !’ মার মুখের দিকে তাকিয়ে খুব মায়া লাগলো, এই মানুষটিকে তো কম কষ্ট দিইনি আমি ! কিছু না বলে মার বুকে ঝাপিয়ে পড়লাম। মা মেয়ের সেকি প্রবল কান্না ! মা বলল, ‘কী হইছে তোর মা ?’ ‘কিচ্ছু হয় নাই, আমি আজকে তোমার সাথে ঘুমামু ! আম্মা আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল, ‘আচ্ছা ঘুমাইও এখন দুই লোকমা খাইয়া লও মা, আমি খাওয়াইয়া দেই ?’ ‘দ্যাও’ ! খাওয়া দাওয়া শেষ করে আম্মার বুকের মধ্যে গুটিসুটি মেরে শুয়ে রইলাম। মা সারারাত ভরে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল !

চাকরি বাকরি বাদ দিয়ে বেকার জীবন কাটাচ্ছি ! এখন চলছে নিজেকে কাউন্সেলিং দেওয়ার পালা ! আমি কী চেয়েছিলাম ? কাজলদা মদ ছেড়ে দিক, ভালো থাকুক; তাই তো ? প্রিয়া নামের মেয়েটি যদি তাকে ভালো রাখে এবং কাজলদা যদি তার সান্নিধ্যে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে আমার তো খুশি হয়া উচিত ! জেলাস হওয়া তো ভীষণ খারাপ ! সো চন্দ্রাবতী চিল কর চিল, নো হিংসুটেপনা ! কাজলদা ভালো আছে তুমিও ভালো থাকো !

ভালো থাকা কি এতই সোজা ? ভালো থাকার চেষ্টা চলতে থাকে !

কয়েকদিনের মধ্যেই আমি ভীষণ ব্যস্ত হয়ে গেলাম ! দম ফেলার সময় নেই ! অবসর সময়টুকুতে কাজলদার ভূত চেপে বসে ! ঠিক আমার পেছনে যেন তার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাই ! হাঁটার সময় মনে হয় সে আমার বাম পাশে আমার সাথে হাঁটছে, গান গাইছে ‘শোন গো দক্ষিণ হাওয়া প্রেম করেছি আমি...।’ বুকের মধ্যে হুহু করে ওঠে কী যেন নেই, কী যেন হারিয়ে গেছে আমার, অত্যন্ত মূল্যবান কিছু। এই জন্যে আরো বেশি করে কাজে মনোযোগ দিই !

বন্ধুদের কাছে খবর পাই সে ভালো আছে ! প্রিয়ার সঙ্গে বন্ধুদের বাসায় ডেটিং করে মদ খাওয়াটাও অনেক কমে গেছে ! প্রিয়ার লেখা ছাপা হয় তার পাতায়। লেখার মান খুবই উন্নত। বন্ধুদের সন্দেহ, কাজলদা নিজেই লিখে প্রিয়া হাসানের নাম দিয়ে দেন! প্রিয়ার অভিনয় করার খুব শখ এই উদ্দেশ্যে তিনি অনেক দিন যাবৎ মিডিয়ায় ধর্ণা দিচ্ছেন। এর আগেও একজন সাংবাদিকের পেছনে অনেক দিন ঘুরেছে বেচারি ! সেই সাংবাদিক কিছুদিন ঘুরেটুরে বিয়ে করে আবার ছেঁড়ে দিয়েছে তাকে। কাজের কাজ কিছুই হয়নি ! কাজলদা তাকে বিখ্যাত ফটোগ্রাফার দিয়ে ফটোশুট করায়, পরিচালকদের অফিসে সাথে করে নিয়ে যান, যে করেই হোক প্রিয়াকে তারকা বানাতেই হবে !

কাজলদার পরিশ্রম সার্থক হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই প্রিয়া লাইম লাইটে চলে এসেছে ! কয়েকদিন না যেতেই পত্রিকায় শিরোনাম চোখে পড়লো জনপ্রিয় অভিনেত্রী প্রিয়া হাসান সুপার মডেল নাদিম মাহমুদকে বিয়ে করেছেন ! খবরের কাগজের বিনোদন পাতায় দু’জনের বড়ো বড়ো ছবি ছাপা হচ্ছে ! টিভি চ্যানেলগুলোতে তাদের ঘরসংসারের তথ্যচিত্র প্রচার করা হচ্ছে ! ভক্তদের মুখে মুখে তাদের সুখি সংসারের গল্প ! মেইড ফর ইচ আদার !

শুনতে পাই কাজলদা’র মদ্য পান ইদানীং বেড়ে গেছে। এখন তিনি আরো বেপরোয়া ! একদিন দুপুরবেলা চুর হয়ে আমার অফিসে হাজির ! অফিসের সবাই তাকে চেনে, লোকজন খাতির করে অতিথি ঘরে বসিয়েছে ! আমি খবর পেয়ে এসে দেখি সোফায় হেলান দিয়ে ঝিমুচ্ছেন ! দরজা খোলার শব্দে চোখ মেলেছে ! তার দিকে তাকানো যায় না, শরীর ভেঙে গেছে, চেহারায় দিশেহারা ভাব ! এতদিনে আমার সব জড়তা কেটে গেছে। তার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম। তিনি উশখুশ করছেন কিছু বলার জন্য। আমি বললাম কী ? তিনি বললেন, এতো বেলা হয়েছে এখনো কিছু খাইনি, চলো একসঙ্গে লাঞ্চ করি ? অফিস থেকে ছুটি নিয়ে তার সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম ! আশেপাশে খাবার হোটেল নেই, তিনি বললেন, আমার বাসায় চল, বাসায় রান্না করা খাবার আছে !

কাজলদা’র দুই রুমের বাসা আসবাবপত্র কিছুই নেই শুধু শোয়ার জন্য তোষক আর বালিশ ! ঘরজুড়ে মেঝেতে সারি করে বই রাখা আছে ! এই বাসায় আগেও অনেকবার এসেছি। কাজলদা বাইরের কাপড় না পালটেই শুয়ে পড়েছেন, আমি গিয়ে তার পাশে বসলাম। আমার হাতটা বুকের কাছে নিয়ে ফিসফিস করে কিছু বলার চেষ্টা করছেন। আমি শুনতে পাচ্ছি না, শোনার চেষ্টা করাও বৃথা। এরপর হালকা নাক ডাকার শব্দ ! ছোট্টো শিশুর মতো গুটিসুটি মেরে ঘুমাচ্ছেন তিনি। আমি একমনে তার দিকে তাকিয়ে আছি। বাঁধভাঙা প্রেম কবেই উধাও হয়ে গেছে ! এখন শুধুই করুণা আর মায়াটুকু বেঁচে আছে ! তার মাথায় কিছুক্ষণ হাত বুলিয়ে দিলাম। মাঝেমাঝে শরীর কেঁপে উঠছে, বোধহয় শীত করছে, বেচারির কাঁথা দিয়ে শরীর ঢেকে দিলাম ! আমার হাতে এখন অফুরন্ত সময়, বইয়ের সারিতে চোখ বুলালাম, কাহলিল জিব্রানে চোখ আটকে গেল, এই বইটা যতবার পড়ি নতুন কিছু না কিছু আবিষ্কৃত হয় !

ভালোবাসা প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন ! ভালোবাসার সংকেত এলে অনুসরণ করো তাকে, যদিও পথ বড়ো কঠিন আর বিষম চড়াই উৎরাই আছে। যখন আড়াল করবে ভালোবাসার পাখায় বিলিয়ে দিও নিজেকে, যদিও ডানার অন্তরালে নিহিত তরবারি আঘাত করবে তোমাকেই... চরম সত্য বলেছেন লেখক নিজেকে দিয়ে উপলব্ধি করতে পারছি !

পড়তে পড়তে জিব্রানে বিলীন হয়ে গেছি... তার কখন ঘুম ভেঙেছে টের পাইনি, এই একটা অভ্যাস বই হাতে পেলে হুঁশ থাকে না আমার ! ইতোমধ্যে কাজলদা ম্যাট্রেস বিছিয়ে খাবার রেডি করে ফেলেছেন। পান্তা ভাত, শুটকি ভরতা, ডিম ভাজি, কোনো সবজির পদ নেই। কারণ, কাজলদা একদমই সবজি খান না ! যদি পড়ত আমার আম্মার পাল্লায় ! নাকে খত দিয়ে সবজি খেতে হতো। বাবাজি তোমার ভাগ্য ভালো এমন মা পাও নাই ! আমরা দুষ্টুমি করতে করতে মজা করে খাওয়া শেষ করলাম ! থালা বাটি গুছিয়ে রাখার পর কাজলদা আমার হাত ধরে টেনে পাশের ঘরে নিয়ে গেলেন। জানলার সামনে নিয়ে বললেন, ‘দেখ’ ! দেখছি জানলার ওপ্রান্তে তাকালে বিশাল একটা নদী দেখা যেত, আমি আঁৎকে উঠলাম, নদীটা কোথায় ? ‘দেখো পাষ-রা কী করেছে, নদীটাকে বেচে দিয়ে বড়ো বড়ো বাড়ি বানিয়েছে এই জন্যেই তো আমি’ ... বাকি কথাটুকু আমি কেড়ে নিয়ে বললাম, ওহ এবার নদীর বিরহে দেবদাস হয়েছেন তাই তো ? হঠাৎ তর্জনি মুখের সামনে নিয়ে আমাকে চুপ থাকতে বললেন। আমি ইশারায় জানতে চাইলাম, কী ? তিনি আস্তে করে বললেন, ‘তোমার মুখের উপর যে আলোটা পড়েছে একে বলে কনে দেখা আলো। এই আলোতে তোমাকে অপার্থিব মানবীর মতো লাগছে’ ! তার এই কথায় আমি হেসে লুটিয়ে পড়লাম ! তারপর খুনসুটি শুরু হয়েছে। কাজলদা নেশার মতো আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে, আমার কোনো ভাবান্তর হচ্ছে না। কোথায় হারিয়ে গেল সেই উন্মত্ত আকর্ষণ ? কোথায় হারায় সবকিছু ? এত বছরের চেপে রাখা কষ্টগুলো, হারিয়ে যাওয়া সুর, ফেলে আসা স্মৃতি, আর ঝরা পাতারা ! এগুলো কোথায় জমে আছে ? জানতে খুব ইচ্ছে হয় !

কাজলদারা গানের একটা দল করেছেন ! পরপর কয়েকটা অ্যালবাম বেরিয়েছে তাদের, গানগুলো শ্রোতামহলে হিট করেছে ! মানুষের বাড়িতে রাস্তাঘাটে মার্কেটে তার গান বাজে ! এত বছরের সাংবাদিক জীবনে যা হয়নি গান বাজারে আসতেই কাজলদা সেলিব্রেটি বনে গেলেন ! আমার ব্যস্ততার কারণে আড্ডা মহলে তার সঙ্গে দেখা হয় না, তার পান-প্রক্রিয়া মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে গেছে। তাকে আর থামানো যাচ্ছে না, সাথে পাগলামিটাও বেড়েছে কয়েকগুণ ! মাতাল হয়ে যার তার সাথে তুমুল ঝগড়া বাঁধিয়ে দেন ! তার এসমস্ত কাজে সবাই বিরক্ত ! আমি কী করবো বুঝে উঠতে পারছি না। বন্ধুরা আমাকে বলে তুই একটু হাল ধর প্লিজ ! মনে মনে ভাবি, তাকে এখান থেকে বের করে আনতে হবে, কিন্তু কীভাবে ? তিনি তো মহাব্যস্ত। আজ মিউজিক ভিডিও তো কাল রেকর্ডিং। এদিকে কিছু মডেলও জুটেছে তার ! সময় কোথায় ?

কবি বেলাল চৌধুরীকে নিয়ে তার জীবনভিত্তিক তথ্যচিত্র নির্মাণ করছি ! দুই বাংলার এই প্রিয় কবির যৌবনের অনেকটা সময় কেটেছে কলকাতায় ; এই কারণে তার কলকাতার বন্ধুদের সাক্ষাৎকার নিতে হবে। এই কাজে জরুরি ভিত্তিতে কলকাতা যেতে হবে। আজ সারাদিন ধরে তারই তোড়জোড় চলছে। রাতে কাজলদা ফোন করলেন ! এখন তো সবার হাতে ফোন, যখন তখন ফোন করা কোনো ব্যাপার নয় ! ‘আমরা দলবেঁধে সুন্দরবন যাচ্ছি, তুমি যাবা আমাদের সঙ্গে’ ? ‘এবার পারবো না কাজলদা, আমি তো সকালের ফ্লাইটে কলকাতা যাচ্ছি’ ! কাজলদা শিশুদের মতো জেদ ধরেছেন, ‘ফ্লাইট ক্যান্সেল করো, চলো আমাদের সঙ্গে নইলে আমি কিন্তু এক্ষুনি তোমার বাসায় চলে আসবো’ ! ‘আমি একটু রূঢ় কণ্ঠে বললাম, না এত রাতে আপনি আসবেন না এবং এবার আমার পক্ষে সুন্দরবন যাওয়া সম্ভব না, নেক্সট টাইম যাবো, ঠিক আছে ?’ বলে আমি ফোন কেটে দিলাম ! মনটা খারাপ লাগছে শুটিংটা না থাকলে সত্যি যেতাম কাজলদাদের সঙ্গে ! এভাবে ফোন কেটে দেওয়া ঠিক হয়নি, বুকের মধ্যে খসখস করছে !

কলকাতায় এসে উঠেছি হিন্দুস্তান পার্কের ‘ভালো-বাসা’ বাড়িতে ! বহুদিন যাবৎ এই বাড়িটি আমার কলকাতার ঠিকানা ! নবনীতা দেবসেন বাড়িটির মালকিন ! তিনি আমার পরম আত্মীয়। দিদি বলে ডাকি। তবে তার সঙ্গে সম্পর্কটা অম্ল-মধুর ! খুনসুটি, স্নেহ, শ্রদ্ধা এবং খুব ভালোবাসার ! বেলাল চৌধুরীর সঙ্গে দিদিরও বন্ধুত্ব দীর্ঘদিনের। তারও সাক্ষাৎকার নিতে হবে কিন্তু তিনি জরুরি কাজে এলাহাবাদ যাচ্ছেন তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে ! আমাকে বাড়িতে রেখে তিনি শ্রাবস্তীকে নিয়ে এলাহাবাদ চলে গেলেন ! শ্রাবস্তী বসু তার পালিত কন্যা। কয়েক বছর হলো তিনি তাকে পালক নিয়েছেন ! শুনেছি শ্রাবস্তীর সঙ্গে দিদির বইমেলায় পরিচয়। দিদিকে মা বলে ডাকে, এখন ‘ভালো-বাসা’ বাড়িতে পাকাপোক্তভাবে বাস করছে ! কী কারণে জানি না তার সঙ্গে আমার বন্ধুত্বটা গড়ে ওঠেনি ! হয়ত একই বাড়ির দুই আশ্রিতা বন্ধু হতে পারে না ! হীনমন্যতা কাজ করে !

তারা চলে যাওয়ার পর আমি কাজে মন দিলাম।

বাড়িতে কানাইদা, ঝরনা দি আছে। আমার খাওয়া-দাওয়ার কোনো সমস্যা নেই ! কানাই, ঝরনা স্বামী-স্ত্রী ‘ভালো-বাসা’ বাড়ির পুরনো কাজের লোক !

স্থানীয় ডিওপি নিয়ে আমি সুনীলদা [সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়] ও অন্যদের সাক্ষাৎকারগুলো নিয়ে নিলাম ! দিদির জন্য অপেক্ষা করছি। এর মধ্যে একদিন খুব খারাপ একটা স্বপ্ন দেখলাম ! আমার খুব পরিচিত একজন মানুষ ট্রেনের নিচে গলা কেটে মারা গেছে ! এমনিতেই কাজলদার সঙ্গে খারাপ ব্যবহারের জন্য মনের ভেতর কাঁটা বিঁধে আছে, তারপর আবার এই স্বপ্ন ! কলকাতায় মন বসাতে পারছি না কিছুতেই। সুনীলদার বাড়ির বিখ্যাত আড্ডাও আমাকে বশে আনতে পারছে না ! দিদি চলে আসাতেই চটজলদি তার সাক্ষাৎকার নিয়ে ফিরতি ফ্লাইট ধরলাম !

ঢাকায় পা দিয়ে সেল ফোনটা খুলতেই টুসটুস করে মেসেজ আসতে শুরু করেছে। মেসেজ অপশনে যাব এর মধ্যেই আবৃত্তিকার শিমুল মুস্তাফার ফোন- হ্যালো বলতেই ও প্রান্তে শিমুলদা অস্থিরভাবে বলছেন, ‘তুমি কোথায় ছিলা বল তো ? ক’দিন যাবৎ তোমাকে ফোন করে পাওয়া যাচ্ছে না’ ? ‘আমি তো কলকাতায়, কী হয়েছে শিমুলদা, আমাকে খুঁজছেন কেন’ ? ‘তুমি কিছু জান না’ ? ‘আমি এইমাত্র প্লেন থেকে নামলাম, হয়েছে কী’ ? তার কণ্ঠস্বরে হঠাৎ পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। তিনি বললেন, ‘তুমি বাসায় যাও আমি বিকালের দিকে ফোন করছি’ ! ফোন কাটার সাথে সাথে আবার ফোন। এবার সাংবাদিক দুলাল খান ! শান্ত কণ্ঠে দুলাল বলছেন, ‘হ্যালো চন্দ্রা আপনি ভালো আছেন’ ? ‘হ্যাঁ ভালো আছি ! আপনি কি দেশে ছিলেন না’ ? ‘না কলকাতায় গিয়েছিলাম, একটা শুটিং ছিল। কেন কী হয়েছে’ ? অপরপ্রান্ত নিশ্চুপ ! ‘কী হলো দুলাল ভাই, চুপ মেরে গেলেন ক্যান’ ? ‘কীভাবে আপনাকে বলব, বুঝতে পারছি না। এদিকে তো একটা বড়ো অঘটন ঘটে গেছে’! ‘কী হয়েছে বলবেন, প্লিজ’ ? ‘কাজলদা তো চলে গেলেন’ ! ‘কাজলদা কোথায় চলে গেছে’ ? ‘না ফেরার দেশে চন্দ্রা’ ! শব্দ ক’খানা বুঝতে আমার সময় লাগলো। পর মুহূর্তে ভেতরটা হাহাকার করে উঠলো, বলে কী ! আমি ভুল শুনিনি তো ? আপনি কী বলছেন, আমি বুঝতে পারছি না। আপনি কি আমার সঙ্গে মজা করছেন’ ? ‘মজা করছি না চন্দ্রা, এটা মজা করার বিষয় নয়’। ‘কাল শহিদমিনারে কাজলদাকে নিয়ে বড়ো আকারে স্মরণসভা হবে আপনি চলে আসবেন প্লিজ, আর পরশু দিন আমরা বন্ধুরা মিলে আলোচনা সভার আয়োজন করেছি, আপনি থাকবেন আমাদের সঙ্গে’ ! তার কথা কিছুই আমার কানে যাচ্ছে না। আমার ভেতরটা অনুভূতি শূন্য হয়ে গেছে। আমি ফোন কেটে দিয়ে রোবটের মতো ট্যাক্সিতে উঠলাম। ঢাকার রাস্তা ফাঁকা, শাঁ শাঁ করে গাড়ি চলছে, রাস্তায় পানি জমে আছে, কালরাতে বোধহয় ঝুম বৃষ্টি নেমেছিল, এখনও ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে, আকাশ মেঘলা ! আমি কাজলদার সেলফোনে কল দিলাম একটি মিষ্টি জীবন্ত কণ্ঠ বলছে আমি যে নম্বরে কল করেছি সেটি বন্ধ আছে ! কী করা যায় ? ভাবতে ভাবতেই আরিফের ফোন, ‘দোস্ত’ ? ‘ক দোস্তো’ ! আমি প্রায় পাগলের মতো বললাম, ‘দোস্ত কাজলদারে ফোনে পাইতেছি না তার মোবাইল বন্ধ কেন দোস্ত’ ? আরিফ বলল, ‘তুই ওই নম্বরে কল দিস না, ফোন করে আর কাজলদাকে পাওয়া যাবে না। সে এসবের ঊর্ধ্বে চলে গেছে দোস্ত’ ! কী কস তুই ? ‘আমরা কেউই এই দুনিয়াতে চিরদিন থাকব না দোস্ত এইটাই নিয়ম’ ! ‘আমি কী করে বেঁচে থাকব বল দোস্ত’ ? এতক্ষণে আমার ভেতর থেকে দমকা হাওয়ার মতো আর্তচিৎকার বেরিয়ে এলো ! কান্নার শব্দে ক্যাবের ড্রাইভার পেছন ফিরে তাকালো। কাঁদতে কাঁদতে আমার হেচকি উঠে গেছে। বাসায় এসে সোজা রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম ! এখন আমার একা থাকা প্রয়োজন !

কাজলদা আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়ার পর তাকে নিয়ে স্মরণসভা আর আলোচনার ঝড় বয়ে গিয়েছিল কয়েকদিন ! আমারও ডাক আসতো, আমি কোথাও যাই না, ইচ্ছে করে না যেতে ! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বরে তার নামে প্রতিবছর মেলার আয়োজন করা হয়েছে বলে শুনেছি ! সেখানেও যাওয়া হয়নি কোনোদিন ! আর নতুন করে ক্ষতবিক্ষত হতে চাই না ! গভীর বিষণœতা থেকে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছি, নানান কাজে ব্যস্ত থাকি ! এখন আমার প্রধান কাজ যেখানেই প্রাণ-প্রকৃতির ওপর হামলা হয়, আমরা দলবেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়ি ! আন্দোলন মিছিল করে প্রতিবাদ করি ! সরকার যখন সুন্দরবনের মধ্যে কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির প্ল্যান করলো, আমরা তার বিরুদ্ধে লং মার্চ করে সুন্দরবন পর্যন্ত হেঁটে এসেছি। এই সমস্ত আন্দোলনে কাজলদা আমার পাশে পাশে থাকে। কেউ তাকে দেখতে পায় না কিন্তু আমি তার স্পর্শ অনুভব করি !

কাজলদা চলে যাওয়ার কয়েকদিনের মধ্যে প্রিয়া আর নাদিম মাহমুদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। তাদের নিয়ে নানাধরনের খবর ছাপা হয় পত্রপত্রিকায় ! প্রিয়ার ভাষায় নাদিম মাহমুদ দায়িত্বহীন মানুষ, সংসার করার অনুপযোগী। নাদিমের ভাষ্য, প্রিয়া হাসান অতি মাত্রায় উচ্চাভিলাসী সংসার করার যোগ্যতা তার নাই ! তবে বিবাহ বিচ্ছেদের পর পরিচালকদের কাছে প্রিয়ার চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে ! টিভি চ্যানেলগুলোও তাকেই প্রাধান্য দেয়! বাংলাদেশের মিডিয়াতে তার দাপট যত বাড়তে থাকে নাদিম মাহমুদ হারিয়ে যেতে থাকে ! তার কোনো খবরই আর পাওয়া যায় না!

শোনা যায়, প্রিয়া হাসানের নতুন গড ফাদার বিখ্যাত মিডিয়া ব্যক্তিত্ব সিদ্দিকুর রহমান ! তিনি একটি বিগ বাজেটের সিনেমা বানাচ্ছেন তার প্রধান চরিত্রে প্রিয়াকে কাস্ট করেছেন ! তিনিই এখন তার বেস্ট ফ্রেন্ড, ফিলসফার, গাইড ! এখন শুধুই এগিয়ে যাওয়ার পালা!

প্রিয়া হাসান এখন আন্তর্জাতিক অভিনেত্রী ! চল্লিশোর্ধ্ব নায়িকা পঁচিশ বছর আগের মতোই লাস্যময়ী আছে, এখনো সে যখন বিকিনি পরে ইন্সট্রাগ্রামে ছবি ডাউনলোড করে। তার ফ্যান ফলোয়ারের সংখ্যা কোটির ঘর ছাড়িয়ে যায় ! কয়েকদিন আগে ইন্টারন্যাশনাল একটা গণমাধ্যমে প্রিয়ার সাক্ষাৎকার দেখলাম। সাংবাদিক প্রশ্ন করছেন... ‘ধুমকেতুর মতো আপনার আবির্ভাব ! এলেন জয় করলেন, শুরুটা কীভাবে হয়েছিল আমাদের দর্শকদের জন্য জানাবেন ?’ প্রিয়া হাসানের উত্তর - ‘আসলে আমি নিজেও জানি না মিডিয়া হাউজগুলোতে কীভাবে আমার ছবি চলে গিয়েছিল ! আমাকে কোনো স্ট্রাগল করতে হয়নি। মিডিয়া হাউজগুলো থেকেই ডাক আসতে শুরু করে ! আমি প্রথম থেকেই বেছে বেছে কাজ করেছি যেহেতু নামকরা হাউজ থেকে আরম্ভ করেছি এর জন্য এগিয়ে যেতে সমস্যা হয়নি !’ প্রশ্নকর্তা আরো নানারকম প্রশ্ন করছে, প্রিয়া হাসান বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে উত্তর দিচ্ছে। তবে কোথাও কাজলদার কথা নেই ! আমি ইউটিউবে ঢুকে তার আরো ইন্টারভিউ দেখলাম, নাহ কোথাও কাজলদা’র প্রতি এতটুকু কৃতজ্ঞতা নেই ! কামিয়াব হতে হলে বুঝি অতীতকে মুছে দিতে হয় ? তাই হবে হয়তো বড়ো বড়ো মানুষেরা বোধহয় এমনই হয় ; আমাদের মতো ছোটো মস্তিষ্কের মানুষের সেটা বোঝার ক্ষমতা নেই !

একটা বিষয় ইদানীং ভাইরাল হয়েছে ! প্রিয়া হাসানের কুকুরের প্রতি ভালোবাসা। প্রায়ই দেখা যায় রাস্তার কুকুরকে খাবার খাওয়াতে ! গণমাধ্যম তার এই মহানুভবতার গল্প, ছবিসহ ফলাওভাবে প্রচার করছে ! দেখতে বেশ ভালো লাগে। স্বীকার করুক আর না করুক সেও হয়তো কাজলদা দ্বারা প্রভাবিত !

আমি বিন্দাস বেঁচে আছি কাজলদার ভালোবাসা আমার সঙ্গে আছে এই কারণে। মর্ত্যলোক আমার কাছে এক কাব্যময়তার জগতে রূপান্তর হয়েছে ! আচ্ছা, এই ভূম-লে যদি গান কবিতা না থাকত তাহলে কেমন ভূম-ল হতো ? আমার দিক থেকে বলতে পারি, আমার বেঁচে থাকাটা কঠিন হয়ে যেত !

মানুষ এই যে এত সাজানো গোছানো একটা বায়বীয় জগত পেয়েছে তা সে বিগ ব্যাঙ্গের মাধ্যমে হোক আর সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিই হোক সেখানে বেঁচে থাকার রসদগুলো নিজেকেই খুঁজে নিতে হয় ! এই খুঁজে নেওয়াটা বড়োই জটিল কাজ ! কেউ বস্তুর পেছনে ঘুরতে ঘুরতে জীবন পার করে দেয় কেউ আবার অচিন পাখির সন্ধানে গোলক ধাঁধার মতো ঘুরতে থাকে ! আমি এই দ্বিতীয় দলের মানুষ !

ভোরবেলা আমার ঘুম ভাঙলো পাখিদের কিচিরমিচির কলতানে, সূর্যের আলোদের তখনো আলস্য কাটেনি, তাদের আমার ঘরে ঢুকতে একটু দেরি হয়ে যায় ! চোখ মেলতেই চোখ চলে যায় ঘরের বিশাল আয়নাটার দিকে, আমার সাথে সাথে কাজলদাও উঠে দাঁড়ায়! আমার মুখের সামনে এসে গভীরভাবে তাকিয়ে বলে, ‘বালিকা আজকে তুমি নীল শাড়িটা পরবে, কেমন ? হাতে রেশমি চুড়ি !’ আমি ছেলেবেলার মতো মাথা ঝাঁকাই- ঠিক আছে !

তাড়াহুড়ো করে অফিসের দিকে ছুটছি, শাড়ি গুছিয়ে পরতে দেরি হয়ে গেল ! নীল রঙের ঢাকাই শাড়ির সাথে ম্যাচিং রেশমি চুড়ি ! ফুরফুরে মেজাজে লিফটে ঢুকেছি লিফটের দরজা বন্ধ হতেই কাজলদা পাশে এসে দাঁড়ালো, কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, ‘বালিকা তোমাকে একদম স্নিগ্ধ সেক্সি লাগছে।’ আমি কি একটু লজ্জা পেলাম ? জানি না ! লিফটের দরজা খুলতেই কাজলদা মিলিয়ে গেল। আমি তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার বুকের ভেতর স্থায়ী চিনচিনে ব্যথাটা অনুভব করছি ! 

অলঙ্করণ : মনিরুজ্জামান পলাশ