একটি পুরনো প্রাসাদ বিষয়ক গল্প -ঈমাম হোসাইন

17 Apr 2024, 02:15 PM গল্প শেয়ার:
একটি পুরনো প্রাসাদ বিষয়ক গল্প -ঈমাম হোসাইন


রাত দ্বিপ্রহর। কাজীর হাটের পাতিলা বাজারের জমাদার কোন এক কাজে দক্ষিণে রওয়ানা হইয়াছেন। আমি বাঁশহাটের মাশুলের হিসাব দিয়া তাহার পিছনে পিছনে হাঁটিতে লাগিলাম। পথিমধ্যে নাড়ু মিয়ার বাজার পার হইতে এক আধা চুল পাকা লোক জমাদারকে ধরিয়া বলিল, আমি জমিদার প্রাসাদের দোতলায় থাকি। পাহারাদার হিসাবে তিন কুড়ি বছর পার করিলাম। কিন্তু কখনও এমন ডাক শুনি নাই। অকস্মাৎ ঘুম ভাঙিয়া দেয়ালের চার পাশে আলোর ঝলকানি দেখিয়া দৌড়াইয়া এখানে আসিলাম। যদি কিছু মনে না করেন, তবে আমার সাথে ঐ প্রাসাদে চলুন।

চলুন বলিয়া জমাদার প্রাসাদের দিকে হাঁটিতে লাগিলেন। আমি তাদের পদাংক অনুসরণ করিয়া প্রাসাদের সামনে দাঁড়ালাম। প্রাসাদের সদর দরজায় জাহান আলী আমার সামনে আসিয়া পড়িল। জাহান আলি একসময় তন্ত্র-মন্ত্র আর যাদু টোনায় ওস্তাদ ছিলেন। সে বামনি নদীর পাড়ে তালমন্ধের হাটে তালের রস চিবিয়ে মিষ্টি বানানোর কারিগর। আজ সেসব বিস্মৃতি। দূরে থাক, দূরে থাক - বলিতে বলিতে উধাও হইয়া গেলেন। আমি অগত্যা প্রাসাদের সম্মুখে দাড়াইয়া ভাবিলাম, জমাদার মহলের ভেতরে গিয়াছে, ফিরিয়া আসুক। তাহাকে লইয়া মোল্লার টেকে এককাপ চা গিলিয়া বাড়ি ফিরিব।

কেহ আমাকে ডাকিয়া বলিতেছে, ভেতরে এসো। বহুদিন তোমাদের দেখা পাই না। আমি কাউকে চাউর করিতে পারিতেছি না। আজ থেকে দুশ বছর আগে ইংরেজ আসিয়া কাজী মিঞাকে ভূস্বামী বানাইয়াছে। এই প্রাসাদ সেই আমলের। আমার বার পুরুষের কেউ কেউ এখানে আসিয়া খাজনা দিয়া যাইতেন। তাহাদের দেয়া তিল তিল করিয়া জমানো টাকায় এই জমিদার প্রাসাদ। মাঝে মাঝে প্রাসাদ হইতে কান্নার শব্দ ভাসিয়া আসে। কখনও আবার জমিদারি আদাবে বলিতেছে, কাল সূর্যাস্তের পূর্বে খাজনা চাই। প্রাসাদের এই সন্দিহান ভাষা আমাকে ভাবিত করিল। কানে আওয়াজ তুলিয়া কেউ বলিতেছি, ভেতরে যাও, প্রাসাদতো আর কাউকে গিলিয়া খাইতে পারে না।

প্রাসাদের সামনে কাছারি ঘর। খোলা দুখান জানালা। বাতাসে বন্ধ হয়, আবার খুলিয়া যায়। আমি উঁকি দিলাম সতর্কে, সঙ্কোচে। ভেতরকার নৃত্যরত নারীরা তাদের পোশাক খুলিয়া পশম টানিতে টানিতে গাহিতেছে, সখি, যাতনা কাহারে বলে.....। মাঝে মাঝে শব্দও শুনি। দমকা বাতাসে শব্দ বুঝাও যায় না। কারও কারও দীর্ঘ নিশ্বাসও শোনা যায়। চোখের ঝলকে দেখিলাম, হায়দারাবাদের নিজাম সরকারের স্ত্রী নর্তকীদের শাসাচ্ছেন। ‘তোমাদের নৃত্যে রক্ত প্রবাহ কোথায় ?’ একবার ভাবিলাম, ভেতরে যাইব। ওইখানকার নর্তকীদের সহিত আলোচনা করিয়া প্রাসাদের ভেতরের খবর লইব।

আমি তালমন্ধের হাটে মরিচের বাজারে ক্ষুদে দোকানি। জীবনের পনের আনা চলিয়া গিয়াছে ঐ হাটে। মাঝে মাঝে শুষ্ক কাশির চাপে দম বন্ধ হইয়া যায় যায় অবস্থা। আমার সামনে অকস্মাৎ এক প্রহরী আসিয়া হাজির। বলিলেন, জমাদার প্রাসাদে গিয়াছেন আপন ভুলে। আমি প্রাসাদে অনেককে ঢুকতে দেখিয়াছি, বাহির হইতে আর দেখি নাই। হাঁপানি বাড়িবার আশংকায় গাছের গুঁড়িতে বসিলাম। তিনি আমায় বলিলেন, এই জমিদার বড়ো এলেমদার। প্রজারা তাহাকে কাজী মিঞা বলিয়া ডাকেন। ধমক দিয়ে আদেশ করিলেন, পায়ে জুতা কেন ? হাতে নিন। এই রাতের আঁধারে যদি কোতোয়াল তোমায় দেখিতে পায়, তাহলে নিশ্চিত থাকুন, গদ্দান যাইবে।

আমি সাহস করিয়া ভিতরে যাইব বলিয়া সিদ্ধান্ত নিলাম। জমাদারকে সাথে নিয়ে বাড়ি ফিরিব। ‘খুব ভালো, চলুন’। ভিতর মহলের দরজার উপর সতর্কবার্তা, ‘বন্ধ দরজা কেউ খুলিবেন না’। আমি পেছনে ফিরিয়া দেখি, প্রহরী পগার পার। আমার সামনে বন্ধ দরজা, পিছনে কালো অন্ধকার। অগত্যা দাঁড়াইয়া রইলাম, কি করি এই ভাবনায়। মাঝে মাঝে মহলটি নাচিয়া উঠে। দরজা খুলিল, বাতাসের জোরে। একি কাজী সাহেব বসে আছেন! হাতের সামনে রৌপ্য, স্বর্ণমুদ্রার থলে। সবগুলো গণনা করিবেন, কিংবা গণনার জন্য খাজাঞ্চির অপেক্ষায় রয়েছেন। আমি নবাবী বোল-চাল জানি না, কুর্নিশ করাও শিখি নাই। অকস্মাৎ দরজা আবার বন্ধ। এইবার আমি কোথায় যাই ? না ভিতরে, না বাহিরে!

প্রাসাদ হইতে একটু দূরে অতিথিশালা সম্ভবত খোলা। কাশ্মীরি, ইরানি, ইন্দো-ইউরোপীয় মশলার গন্ধ নাকে ভাসিয়া আসিতেছে। জমিদার মিঞা সাহেব হয়ত ইংরেজ ও তাদের দুই পাওয়ালা কুকুরদের খাওয়ানোর জন্য এই রাজকীয় অতিথিশালা খুলিয়াছেন। আমি বাহির হইবার পথ খুঁজিতেছি। মাঝে মাঝে ভাবিতেছি, আমি বামনীর খলিল বাড়ির অলিল বংশের কোন এক আদম সন্তান। আমার সহিত প্রাসাদের শত্রুতা কেনই বা হইবে ? প্রহরী উপস্থিতি জানাইয়া বলিলেন, কিছুক্ষণ পর প্রাসাদ ফুলিয়া উঠিবে। চলুন, আমার সাথে। রাতের শেষ ভাগ, কাছারি ঘরে শুইবেন। আমি জমিদারের কথা জিজ্ঞেস করা মাত্র বলিলেন, এখানে সবাই পর, আপন কেবল জমিদার।

আমি নিজেকে ফিরিয়া পাইলাম পান কাজী বাড়ির সদর দরজার সামনে। সংবিৎ ফিরিয়া আসিল। কিন্তু বুঝিতে পারিলাম না, কীভাবে তালমন্ধের হাট পেরিয়ে কাজীর হাট মাড়িয়ে অবশেষে এই দরজায় এলাম। কিছুক্ষণ পর আকাশে ভাসিয়া উঠিল, আস সালাতু, খায়রুম মিনান নাওম।

অলঙ্করণ : মনিরুজ্জামান পলাশ