অতঃপর একদিন নির্ভার বা অন্যকিছু -জোবায়ের মিলন

17 Apr 2024, 02:17 PM গল্প শেয়ার:
অতঃপর একদিন নির্ভার বা অন্যকিছু -জোবায়ের মিলন


ঝাপির ভেতর থেকে কাছিমের মতো মাথা বের করে সূর্যের দিকে তাকায় তোরাবউদ্দিন। আবার ঝাপির ভেতরে মাথা ফিরিয়ে নেয়। মাইজুর বাপ তা দেখে। দেখে না দেখার ভান করে সেও সূর্যের দিকে তাকায়। ম্যাচের কাঠির ঠোক্করে হাতের বিড়িটা ধরায়। এক পা, দু-পা করে ঝাপির ঝাপের কাছে এসে জিজ্ঞাসা করে, ‘কী তোরাব ভাই, শইলডা বালা না ?’

তোরাবউদ্দিন আবার মাথাটা কিঞ্চিত রেব করে। কয়েকটা কাশি দেয় খুক খুক করে। ভারি কফ বুকের ভেতরে ঝনঝন করে উঠলে একটু দম নেয়, আবার খুকখুক করে কাশি দেয় আরও কয়েকটা।

‘তোমারে না করছি উপার হইয়া না হুইতে ? হোনো না ক্যান, হ্যাঁ ?’ তোরাবউদ্দিনের ছেলে তাজুল পাশ থেকে ছেদ করে ওঠে। মাইজুর বাপ তোরাবউদ্দিনের ছেলের সঙ্গে গলা মিল করে বলে, ‘কথা তো ঠিক তোরাব ভাই। হুনো নাই-উপার হইয়া হুইলে পেটের ভাত গলায় আইসা বান ঠেহে! হোও, চিত হইয়া হোও, না হয় হেলান দিয়া হোও!’

বিড়িতে টান দিতে দিতে মাইজুর বাপ ধোঁয়া ছাড়ে বাতাসে। ধোঁয়া কু-লি পাকিয়ে বাতাসে মিলায়। তোরাবউদ্দিন সেই মিলিয়ে যাওয়া ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। তবে চুপ করে থাকে না-‘তুই এত ক্যাচ ক্যাচ করছ ক্যা, কওছান দি! ভাল্লাগে না।’

‘আমি ক্যাচক্যাচ করুম ক্যা, তাই না, আমি করুম ক্যা। অসুখ অইলে তো তোমার বাপের তালুক থাইকা ট্যাকা আইব, আহে না ?’

‘বাপ তুইলা কতা কবি না কইছি তাজুল।’

‘তয় কী তুইলা কমু, কও; কী তুইলা কমু ?’

‘তোমরা থামবা! এই ভরদুপুরে কেউ এমন করে, বাপ-পোলায় দেহি একদ-ও মিশ-খাও না। থামো তোরাব ভাই। থাম তাজুল।’ মাইজুর বাপ বিরক্ত হয়ে বলে।

ঝাপি থেকে হন্হন্ করে বের হয়ে যাওয়ার সময় তাজুলের কনুই কঞ্চির আড়ে বানানো ঝাপের সঙ্গে যে আঁচড় খায়, তাতে ঝাপের যদি প্রাণ থাকত-তাজুলের মতনই ‘ক্যাৎ’ করে উঠত। কিন্তু ঝাপ থেকে কোনো শব্দ উঠে আসে না, শুধু দুটি দোল খায়।

তোরাবউদ্দিন চোখ ফিরিয়ে তাকায় মাইজুর বাপের দিকে। মাইজুর বাপ তোরাবউদ্দিনের বয়সের চেয়ে কয়েক বছরের ছোটো, তবে ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মতো। মাইজুর বাপও চোখ ফেরালে তোরাবউদ্দিন বলে, ‘কাম-টাম কিছু পাইলি মাইজুর বাপ ? ঘরে আর কত বইয়া থাকমু। গিটেগিটে তো পচন ধরতাছে।’

‘কী কাম করবা তুমি, কাম কি চাইলেই পাওন যায়, কী কামই-বা পারবা।’

‘নতুন স্টিশনে, না-অয় বাজারে কোনো কাম নাই! তুই-ত ওই দিকে যাওয়া-আসা করছ, কোনো খোঁজ পাইলে কইছ।’

‘তা না-অয় কইলাম। এই শরীর নিয়া কাম করতে পারবা ?’

‘পারমু। পোলার কতাবাত্তা ভালা লাগে না, হুনলাই-তো; আরে বাপেরেই-তো দুইডা খাওয়াস। মাইষ্যেরে- তো না। দেখলা-না কতার কি ফুটাংগি ?’

‘হ দেখলাম।’


‘আইচ্ছা নাদু, ঘাট কি আর চালু হইব না! সব মানুষ কি বিরিজের উপার দিয়াই আইব-যাইব ? হুনছি বারো বছর পরপর নাহি যুগ ফিরা আহে ; তাইলে ঘাটের চল কি আবার ফিরা আইব ?’

‘কী যে কও তুমি, ঘাট ভাঙ্গে বছর বছর আর বিরিজ ভাঙে কয়েক’শ বছর পর। তার উপারে যে যুগ! হাজার বছরের টেকশই কইরা নাহি বিরিজ বানায়। এই বিরিজও হেইরহম। হুনছি।’

‘তাইলে আমরা কি আর নাও বাইবার পারুম না! নাওয়ে কি আর কেউ উঠব না, পারাপার অইব না ?’

‘দেহো না বিরিজ দিয়া শো শো কইরা পার অয় কত কত বাস, ট্রাক, লরি, পিকআপ, জিপগাড়ি... নৌকা দিয়া কি এইসব পার হইতে পারব ? সরকার চাইতাছে পুরা দেশটা আগায় নিতে। দেহো না খালি বিরিজ আর বিরিজ-উড়াল বিরিজ, ওভার বিরিজ, পাতাল বিরিজ, বেইলি বিরিজ, আরও কী কী কয়। সব গ্রাম-শহর অইব, সব ঘাটে বিরিজ অইব ; দেশ অইব ফকফইক্কা, জানো ?’

‘আমার ঘরে-ত টিভি নাইরে, অত কিছু জানি ক্যামনে ?’

‘টিভি নাই-ত কি, মুবাইল আছে না! ছুডু মুবাইলেও এহন কত্ত খবর আহে, দেহো না ? চান্দে মানুষ যাইতাছে, সূর্যেও নাহি যাইব! দুনিয়া আর আগের জায়গায় নাই বাইজু, আরও আগাইব।’

একই নিবাসী নাদু একটানা কথা বলতে থাকলে তোরাবউদ্দিন মাটিতে পাতা চাটি থেকে উঠে চৌকির উপর বসে হাটু ভাঁজ করে। এক বহায় বেশিক্ষণ থাকলে কোমরের ব্যথাটা বাড়ে, মাটির ঠান্ডায় কাশিও বাড়ে।

‘বিড়িডা কি ফালায় দিছস ?

‘না’।

‘দে একটা টান দেই।’

‘দিও না, তোমার পোলায় খেকখেক করব। যেই পোলার পোলা, এমন মেজাইজ্জা পোলা তোমার ঘরের, বুঝাই যায় না।’

‘দে, দেখব না।’ নাদু বিড়িটায় আরেক টান দিয়ে বাড়িয়ে দেয় তোরাবউদ্দিনের দিকে।


চিটাগাং রোডের মোড় থেকে ওয়াবদা খালের পাড় ধরে সোজা যে পুরনো পাকা রাস্তা উত্তর দিকে ডেমরা চৌরাস্তার দিকে গেছে, তার গা ঘেঁষে যে তিন বিঘার মতো খাস জমিন-তার পাড়ে গড়ে ওঠে যে কানাপট্টি বস্তি, তার মধ্যে একটি ঝাপিতে ভূমিহীন কয়েকজনের সঙ্গে ঠাঁই তোরাবউদ্দিনের। বয়স ষাট ছুঁই ছুঁই।

তোরাবউদ্দিন অনেকের চেয়ে দুর্বল। জোর কম। রোগের সঙ্গে যুদ্ধ করে নাজেহাল। ছেলের সংসারে ভার। বিপতœীক। বেলায় বেলায় মরে মরে। অসুখে-ওষুধে আর-দশজনের যে হাল-তার চেয়ে তার অনোত্তম। ছেলে, ছেলের বউ, নাতি-নাতনিতে ছোট্ট ঝাপিটায় ঠাসাঠাসি।

তোরাবউদ্দিন ভাঙা আয়নায় নিজের মুখ দেখে। যখন গলা আর বুকে দুই দুধের ঝুলে পড়া মাংসের দিকে তাকায় তখন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, ‘আহ, কী শইল কী অইছে!’

তোরাবউদ্দিনের জীবন ছিল মাঝির জীবন। তখন ছিল হাটের মতো ঘাট। দশ অঞ্চলের লোকে লোকারণ্য ছিল বারো মাস। দিনে রাতে লোক আর লোক। কোথা থেকে এত লোক আসত, কেউ জানে না। বড়ো বড়ো জাহাজ, বোট; আসত-যেত ঘাট ছুঁয়ে। ঘাটে ভিড়ে থাকত শ-খানেক নৌকা। হৈ-হৈ করে মানুষ উঠত, হৈ হৈ করে নামত। মাঝিরা কার আগে কে যাবে-পাল্টাপাল্টি লেগে থাকত সারাক্ষণ; কী সকাল, কী বিকাল, কী রাত-নিশি। বাউয়ানি জুট মিলের ছুটি হলে মানুষের মাথা মানুষে খেত। নৌকায় উঠলেই টাকা। খাওনে পরনে বাহু ছিল বাঘের মতো। কোনটা বাহু, কোনটা বৈঠা ধরা যেত না। মাঝি বলে কী যে কদর তখন।

শীতলক্ষ্যা নদী। তার ঘাট। কে না জানে এই ডেমরা ঘাট দিয়ে এককালে ফেরি চলত। ঢাকার সাথে সিলেটের, চট্টগ্রামের যোগাযোগ। এরপর কত কাল গেল। কত জল বিস্তৃত হলো, তারপরও ঘাট ছিল। পশ্চিমে ডেমরা, পুবে তারাবো। আঘাট ঘাট হয়েছিল, ঘাট হলো বিরাণ। আচমকা সুলতানা কামাল ব্রিজ।

আচমকা! দোষ দিয়ে লাভ কী। শুনতে শুনতে ঘাটের সঙ্গের বাউয়ানি মিল বন্ধ হলো। করিম জুট মিল অর্ধেক হলো। কত কত সুতার কল উঠে গেল। পাটের জাহাজ মুখ ফেরাল। ঘাটের নৌকা, ডিঙ্গি এক এক করে কমতে শুরু করল।

ব্রিজ উদ্বোধন হলে গাড়ি যায়, গাড়ি আসে। নৌকা গেল কই! ডিঙি গেল কই! বৈঠা গেল কই! আয়নাল মাঝি, ধনু মাঝি, আফাল মাঝি, ফরিদ মাঝি, ময়নাল মাঝি. . . আরও আরও, কে রাখে কার খবর!

যুগের উত্তরণ ভেঙেচুরে এক করে দিল। খা খা পড়ে আছে সে নামকরা ঘাটের ইট, কঙ্কর, টুকরা; সেইখানে ঘুমায় অসংখ্য মাঝির ফেলে আসা সুখ, দুঃখ, হাসি, কান্নার চাপা আর্তনাদ।

শরীরে জোর ছিল তোরাবউদ্দিনের। পাঁচজনেও বৈঠা বেয়ে পারত না তার সঙ্গে। নৌকা আছিল বড়ো একটা। আয় রোজগার মাশাল্লা। কে জানত দিন ফুরাবে!

আজন্মের পেশায় নামল ভাটির নিশি? কর্মহীন তোরাব, বেকার তোরাব, তক্কি, আমিন, আওলাদ, জমির, সাঈদ-শ’খানেক। রোজ যে মুখগুলো মুখের পরিচিত, রোজ যে আত্মা-আত্মীয়, তারা নেই। যে যার মতো ভেসে গেছে. যেমন দিনে দিনে ভেসে এসে ভিড় জমেছিল একদিন।

এমনই-ত নিময় মনে অয়, তাই না ? তোরাবউদ্দিন নিজের সঙ্গে নিজে অফুরান কথা বলে যায়। স্মৃতির ভাসানে যেন সে এখনো নৌকা বায় গান গেয়ে গেয়ে।


‘তোমারে না কইছি রোজ রোজ ওই মরা ঘাটে যাওনের দরকার নাই, তা’ও যাও ক্যান বাজান! কানাপট্টি থাইকা অদ্দুর যাইতে-আইতে যদি ফসকাইয়া পড়ো আর উঠতে পারবা? বিরিজের গোড়ায় রাস্তা যে চওড়া হইছে, তা পার হইতে যাইয়া যদি গাড়ির তলে হান্দাও, কে বাঁচাইব!’

‘মরলে তো বালাই আছিল রে পুত, মরিও তো না।’

‘রাহো চাই আ-কতা। ওই ঘাটে দিনে দুফুরেও কেউ থাহে যে তোমারে সঙ্গ দিবো ? ওইডা তো এহন একটা গোরস্থান।’

‘পাড়ত বইসা থাহি, পানির কাছে যাই না।’

‘বইসা থাহন লাগব না। কেডা যায় আর তোমার লাহান। যায় কেউ ?’

‘না গেলে যে শরীর ধড়ফড় করে। হাত দুইডা নিসফিস করে। কেমন জানি হাহুতাশ লাগে খালি।’

‘লাগুক। ঘরে বইস্যা থাহো, বিপদ টাইনা আনার দরকার নাই। ঘাট পতিত হইছে। চিহ্নমাত্র নাই, বুঝার উপায় নাই, ওই ঘাট এককালে বাজার আছিল্। এহন ওই দিকে ভূতেও মুখও ফিরায় না।’

‘আমার যে ওই দিকে চাইয়া থাকতে মন চায়। হুইয়া থাকতে ইচ্ছা করে ঘাটটারে বুহের নিচে লইয়া। ঘরে চৌকিতে হুইলে বৈঠার বারি কানে বাজে। জলের আওয়াজ হুনি। আমি ঘুমাইতে ফারি না। কী করমু ক ?’

‘নদু কাহাও-ত তোমার লাহান নাও বাইছে, মাইজুর বাপও। জলে, ডাঙ্গায় সম্পর্ক সমান। কই, তারা-তো এমন কায়ার মায়ায় পড়ে নাই।’

‘মায়া কি সবার এক রে। কার কখন কিসে মায়া পড়ে, কওন উঠে, কেউ জানে? সেই-যে বাপের আঙুল ধইরা নায়ে উঠছিলাম, বৈঠা ধরছিলাম. . .’।

‘তোমারে কইছি যাওন লাগব না, যাইবা না। যাইবাই না।’

তোরাবউদ্দিনের চোখ দিয়ে দরদর করে পানি ঝরলে তাজুল আবার ধমকায়, ‘কইছি না কানবা না ? নাও নাও, ঘাট ঘাট কইরা তুমি মরবা।’


‘আমার কী মন চায় জানস, বাইন্যা ? মন চায় ঘাটের কিনার ধইরা জলের উপার দিয়া আটতে আটতে পুরা নদীডারে বাইচ দেই। একটা কলা গাছ কাইট্টা, তার উপার একটা ডেরা বানাইয়া বারো মাস ভইস্যা থাহি। আমার মন চায় বিরিজের দুই মাথায় গিয়া মাইন্ষ্যেরে ডাইকা ডাইকা কই- আহেন ভাই আহেন, আমারডায় উডেন, তারাতারি যামু ভাই আহেন, বাসের চাইতে, লেগুনার চাইতে, টেকচির চাইতে আগে যাইতে না পারলে ট্যাহা দিয়েন না... ’।

‘এইডা কি অয়! ঘাট দিয়া পার হইতে যে সময় লাগব হেই সময়ে মাইন্ষ্যে বিরিজ দিয়া চাইর বার নদী পার হইতে পারব। মালামাল আনতে নিতে পারব। তুড়ি দিলেই এইপাড়, তুড়ি দিলেই ওইপাড়। কে উঠব তোমার নৌকায় ?’ গতি কাহা, গতি। মাইন্ষ্যে প্লেনের লাহান ছুটতাছে। এ-তো দেখছ একটা বিরিজ। হায়াতে বাঁইচ্চা থাকলে এই নদীর উপারে কত কী যে দেখবা। ঘাট বইলা কিছ্ছু থাকব না। মনে নাই তোমার দাদায় নাহি এই ঘাটে ফেরিতে কাম করত, ডেক পরিষ্কারের। কাঁচপুর বিরিজ হওনের পর ফেরি বন্ধ হইছে, হেয় কি মইরা গেছে, কও ? বাঁচনের লাইগা বাঁইচা থাকতে অয়। যা গেছে তা নিয়া পইড়া থাইক না কাহা। পারলে একটা কিছু ধরো। পানের দোহান দেও, গ্যারেজে টুকটাক করো, না অয় বাজারে নিমকির টুকরি লইয়া বহো।’

‘জন্মের পর যা দেখছি, যা হিখছি, যে আতের কব্জিতে চইরের দাগ, বৈঠার দাগ, সেই আতে অন্যকিছু জুটব! কিয়ের লগে কি মিশাইলে খিলিপান অয়, তাও কি হিখছি কোনোদিন? আর বাজারই বা কই! দুই পাড়ই-তো ল-ভ-।

আইচ্ছা বাইন্যা, ছলিম জেডা, আনসাইরা, কালাম মোল্লা, বাবু, বিশা কী করে জানস ? তারাও কি আমার লাহান কাম ছাড়া, বেগার, রোগা ?’

‘ক্যামনে কমু, নাও ছাড়ার পর কিচ্ছুতে মন টেকে না। যন্ত্রের দিন আইছে, যন্ত্রের লাহান সব কিছু, মানুষ আর যন্ত্রের মইধ্যে ফারাক নাই।’

‘এই বিরিজ না উঠলে দেশের কী ক্ষতি হইত ?’

‘হয়তো অইত, হয়তো অইত না, আমার মতো মুখ্খ বাইন্যা কি এসব জানে ?’

‘বিরিজ করনের আগে কেউ কি জিগাইতে পারত না, তোমরা কী কইরা থাকবা, কী কইরা খাইবা, কী কইরা পরবা ? কই যাইবা ? একটা জোগান কি দিতে পারত না, যারা বিরিজ বানাইছে ? একটা কাম বদলান কি সহজ’রে বাইন্যা ? পোলাডারে কিছু পড়াইছিলাম, মাতাও আছিল ভালা, পাশ দিতাছিল। ভাবছিলাম, আর কয়ডা পাশ দিলে কলেজে পড়ামু। একটা ভিটা কিনমু, কত স্বপ্ন দেখছি।’

‘মনে অয় একটা যোগান দিয়া বিরিজ তুললে বালা অইত।’

‘ঘাট কি আমগোরে ভুইলা গেছে ?’

‘ভুলব না আবার।’

‘ঘাট না থাকলে জলও নাহি এতিম, হুনশনি। দাদি কইত। আর আমরা-তো কয়জন মাজি।’

‘আমি তো এহনও পানির ডাক হুনি, আমারে ডাহে, তোরাব. . .তোরাব, কইয়া।’

‘তুমি বুঝি শীতলক্ষ্যার কেউ অও, এই ঘাটের অও!’ বাইন্যা হাসে।

‘অই তো, না অইলে ডাহে ক্যা ?’

‘কিছুই কি আছে এহন ?’

‘না, পশ্চিম পাড় দিয়া ডেমরা বাজার থিকা ডেমরা ঘাট হইয়া ডেমরা চৌরাস্তার দিহে যে চলতি পথ আছিল তা উদাও। রাস্তাটা নীরব, গা ঝমঝম করে। বাউয়ানীর প্রাচীরে ফ্যাওলা। ক্রেন নাই, হাঁক নাই, ডাক নাই। কুলির মিন্তির হাউকাউ নাই, পাটের গন্ধ নাই, জাহাজের জটলা নাই, মিল ছুটির হুইশাল নাই, গুদাম নাই, কলের কলকল নাই, দোকন-পাট নাই, শীতলক্ষ্যার জল কালির লাহান কালা। আরেক পাড়ে কারখানা আর কারখানা। তাতের বুনন নাই, সুতার মাকুর শব্দ নাই, একটা বিরিজের লগে খালি মাজি! কত কী যে নাই, কত কী যে তৈয়ার হইছে, এ এক আজব কারবার। ভাল্কহেড আর ভাল্কহেড। গড-গড গড-গড। ধোঁয়ায় ধূসর। পাথরের, সিমেন্টের, রঙের, তেলের, তারপিনের বোঝাই শিপ নোঙর কইরা থাহে, যেন্ দুনিয়ার তাবৎ কারখানা এই শীতলক্ষ্যার দ্ইু তীর জুইড়া। চিনচিন কইরা ওঠে বুকের দুই দ্বার। একি যুগের নিঠুরতা, না দাবি ?’

‘জানি না মাজি। খালি মনে অয় নদীটায় ঝাপ দেই, মনে অয় তার তলে আরেকটা ঘাট, নাও, বৈঠা, জনরবের দিনগুলা আবিষ্কার করি। যদি আবার ফিরা পাইতাম ?’

বস্তির শেষ দিকে অনেকটা নীরব। লোকজন কম। একসময়ের সঙ্গী কাসেম মাঝির সঙ্গে পুরনো স্মৃতি হাতরায় তোরাবউদ্দিন। কাসেম তার সেই জীবনের বারবার গাওয়া গানটায় টান দেয়, ‘মাঝি বাইয়া যাওরে. . .মাঝি, বাইয়া যাওরে,/ মাঝি, তোমার ভাঙা নাও’রে মাঝি, তোমার ভাঙা নাও. . .’

পরের দিন। বর্ষায় ভেজা রাত।

‘বাজানে কই গেছে ?’ তাজুল ঘরে ফিরে জানতে চায়। ‘আমি ক্যামনে কমু।’ তার বউয়ের উত্তর। ‘বাইত থাহছ তুই, কমু কী আমি ?’ ‘আইজ ছুটার কামে গেছিলাম, আইতে দেরি হইছে। আফনের পোলারে, মাইয়্যারে জিগান।’

তাজুলের স্ত্রী আফিয়া রান্নার জোগারে বসে। তাজুল পাক দেয় বস্তি আর কানাপট্টির পুরোটা, কোথাও দেখে না তোরাবউদ্দিনকে। ফিরে আসে ঘরে। আবার বের হয়।

‘রাইত দশটা বাজে, অহনও ঘরে আহে নাই! অত দেরি তো করে না হেয়!’ চমকে ওঠে তাজুল। একাই বিড়বিড় করে নিজের মেয়ে সাফিয়াকে ডাকে, ‘তোর দাদা কই গেছে সাফিয়া, কইয়া গেছে ?’

‘দাদায়-তো হেই বিকালে বাইর হইছে। আর আহে নাই। আমি পরি বুজির লগে খেলছি।’

তোরাবউদ্দিন ফেরে না। রাত এগারোটা, রাত বারোটা, রাত একটা।

‘আমি আর কই খুঁজমু! কেউ-তো কইল না দেখছে। কত্তদিন কইছি, এই শইল লইয়া বাইরে যাইয়্যো না, যাইয়্যোনা। বুইড়া মানুষ মাইন্ষ্যের চোদা না, খামুখা কয় মাইন্ষ্যে। গেলে তো ব্রিজের নিচে, ঘাটে; আর তো যায় না বস্তি ছাইড়া কুনুখানে।’

গলা ধরে আসে তাজুলের। পিতার অনুপস্থিতি বুকের ভেতরে কামড় বসায়। মাঝরাতে সাড়া পড়ে কানাপট্টি বস্তিতে-

‘তোরাব মাজিরে পাওন যাইতাছে না...’।

তোরাবউদ্দিনকে চেনে এমন কেউ চুপ থাকে না; বাইন্যা, নান্দি, এখলাস, আব্দুল, আখির, দোহা, মাইজুর বাপ, যারা তার সঙ্গে ওডে-বসে, সব্বাই খোঁজে নামে। ঘুরেঘুরে ঘাটের কাছে যায়, ঘাট খালি। উদাম। নীরব।

বাতাসে শো শো আওয়াজ। দু’একজন হঠাৎ আসে যায় ঘাটের পাড়ের রাস্তা দিয়া-‘তোরাবউদ্দিনরে দেখছ তোমরা ?’ জানতে চাইলে কেউ দেখেনি, জানায়। চেনারা চারদিক তন্ন-তন্ন করে দেখে। বয়স্ক দিলু মিয়া বলে, ‘আরে যাইবই-বা কই। নদীটাতে চোখ রাখ।’ থানা, হাসপাতাল, নদীর চর, চলন দিক; সারাদিন তোরাবউদ্দিনের খবর পাওয়া যায় না। এইদিন, পরের দিন, পরের দিন...

তাজুল প্রতিদিন কাজ থেকে ফিরে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ঝাপির দরজা দিয়ে উত্তরের খোলা রাস্তাটির দিকে। তার নাবালক ছেলে তাহিরুল একটা কাগজের নৌকা বানিয়ে খেলতে বসে তার হাঁটু ঘেঁষে। বলে, ‘বাজান, দাদায় কি আর আইত না ?’ 

অলঙ্করণ : মনিরুজ্জামান পলাশ