বাংলাদেশ ধর্ম নিরপেক্ষ দেশ। প্রায় সব ধর্মের মানুষের বসবাস এই দেশে। বিয়ে একটি সামাজিক প্রথা। সব ধর্মের মানুষই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তবে প্রতিটি ধর্মের বিয়ের রীতিনীতি ভিন্ন। বিভিন্ন ধর্মের বিয়ে ও বিশেষ আইনে বিয়ে নিয়ে প্রতিবেদনটি সাজিয়েছেন শেখ সেলিম...
ইসলামি বিয়ের নিয়ম ও বিধান
বিবাহ আল্লাহর বিশেষ নেয়ামত ও রাসুল [সা.]-এর গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত। আদর্শ পরিবার গঠন, মানুষের জৈবিক চাহিদা পূরণ ও মানবিক প্রশান্তি লাভের প্রধান উপকরণ। বিয়ে ইসলামি শরিয়তের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিধান। ইসলামে বিয়ের যাবতীয় নিয়মকানুন, বিধান-শর্ত ও আনুষাঙ্গিক বিষয় তুলে ধরা হলো-
ইসলামে বিয়ের মৌলিক ভিত্তি
১. বর-কনে উভয়ে বিয়ে করার জন্য সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা থেকে মুক্ত হতে হবে।
২. প্রস্তাবনা : এটি হচ্ছে বরের কাছে মেয়ের অভিভাবক বা তার প্রতিনিধির পক্ষ থেকে বিয়ের প্রস্তাব উপস্থান করা। যেমন, ‘আমি অমুককে তোমার কাছে বিয়ে দিলাম’ অথবা এ ধরনের অন্য কোনোভাবে প্রস্তাব পেশ করা।
৩. কবুল : এটি বর বা তার প্রতিনিধির সম্মতিসূচক বাক্য। যেমন, ‘আমি কবুল বা গ্রহণ করলাম’ ইত্যাদি।
বিয়ে শুদ্ধ হওয়ার শর্ত
ক. বর-কনে উভয়কে গ্রহণযোগ্যভাবে নির্দিষ্ট করে নেওয়া।
খ. বর-কনে একে অন্যের প্রতি সন্তুষ্ট হওয়া।
গ. বিয়ের আকদ [চুক্তি] করানোর দায়িত্ব মেয়ের অভিভাবককে পালন করতে হবে।
ঘ. বিয়ের আকদ-এর সময় সাক্ষী রাখতে হবে। সাক্ষী এমন দুইজন পুরুষ [স্বাধীন] সাক্ষী বা একজন পুরুষ [স্বাধীন] ও দুইজন মহিলা সাক্ষী হতে হবে, যারা প্রস্তাবনা ও কবুল বলার উভয় বক্তব্য উপস্থিত থেকে শুনতে পায়।
কনের অভিভাবক হওয়ার জন্য শর্ত
১. সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন হওয়া। ২. প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া। ৩. দাসত্বের শৃঙ্খল হতে মুক্ত হওয়া। ৪.অভিভাবক কনের ধর্মানুসারী হওয়া। ৫. ন্যায়পরায়ণ হওয়া। ৬. পুরুষ হওয়া।
হিন্দু আইনে বিয়ে
হিন্দু বিবাহের মধ্যে অন্যতম বর বরণ। বর বিবাহ করতে এলে মঙ্গল প্রদীপ, সাথে ধান ও দুর্বা দিয়ে কনের মা তার জামাতাকে বরণ করেন এবং সেই সাথে দুধ ও মিষ্টি খাওয়ানো হয়।
শুভদৃষ্টি
হিন্দু শাস্ত্রে বিবাহের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ শুভদৃষ্টি। বর এবং কন্যা পক্ষের সকলের উপস্থিতিতে বর ও কনে একে অপরের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করেন। ধর্মীয় মতে এই মুহূর্তটাই শুভদৃষ্টি।
মালা বদল
বর এবং কনে একে অপরের সাথে মালা বিনিময় করেন। এই রীতির অর্থ হচ্ছে দু’জন একে অন্যকে জীবনসঙ্গী হিসেবে মেনে নিলেন।
সাত পাক
হিন্দু বিবাহের গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি অংশ হলো সাত পাক। অগুন সাক্ষী রেখে মাঙ্গলিক মন্ত্র পাঠের মাধ্যমে বর ও কনেকে বিবাহ ম-পের চারপাশে সাত পাক ঘোরানো হয়।
সিঁদুর দান
বিবাহের শেষ রীতি হলো সিঁদুর দান। বর কনের কপালে সিঁদুর লেপন করেন। বাঙালি হিন্দু নারীরা স্বামীর মঙ্গল কামনায় সিঁদুর পরেন।
খ্রিস্টানদের বিয়ের নিয়ম-কানন
খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের কাছে বিয়ে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও পবিত্র চুক্তি। তাদের বিয়ে লিখিত মাধ্যমে সম্পাদিত হয়। বাধ্যতামূলকভাবে করতে হয় রেজিস্ট্রি। খ্রিস্টান বিয়েতে রেজিস্ট্রেশন ও আইনগত যে বিধান রয়েছে তাতে স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই স্বার্থ রক্ষার কথা বলা হয়েছে।
বাংলাদেশে ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দের খ্রিষ্টান ম্যারেজ অ্যাক্ট [খ্রিষ্টান বিবাহ আইন] অনুযায়ী, খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের বিয়ে সম্পাদিত হয়। তাদের বিয়ে রেজিস্ট্রি করার আগে কিছু নিয়ম পালন করতে হয়, যা অন্যান্য ধর্মের চেয়ে কিছুটা আলাদা।
খ্রিস্টান বিয়েতে রেজিস্ট্রেশন করার আগে বাধ্যতামূলক বিষয়গুলো হলো :
গির্জার কাছে নোটিশ
বিয়ে রেজিস্ট্রেশনের আগে পাত্রপাত্রীর পুরো নাম, ডাক নাম, পেশা বা অবস্থা ও বাসস্থানের ঠিকানা গির্জার কাছে নোটিশ আকারে পাঠাতে হবে। নোটিশ প্রাপ্তির পর গির্জার যাজক নোটিশটি খোলা জায়গায় টানিয়ে দেবেন যাতে বিষয়টি সবার নজরে আসে।
আপত্তি বিবেচ্য
পাত্র ও পাত্রী পক্ষের পাঠানো নোটিশ কয়েক সপ্তাহ ঝোলানো থাকবে। নোটিশের কোনো বিষয়ে আপত্তি থাকলে তা গির্জায় জানাতে হবে। আর আপত্তি না পেলে গির্জার প্রধান বিয়ের দু’টি পক্ষের কাছ থেকে একটি ঘোষণা গ্রহণ করবেন। এছাড়া এই ঘোষণাটি বিয়ের পক্ষগুলো ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির হয়ে দেবেন। সেই ঘোষণায় কিছু বিধিনিষেধ আছে যা দুই পক্ষকে পূরণ করতে হবে।
আত্মীয়তা বা রক্তের সম্পর্ক
পাত্র-পাত্রীর মধ্যে বিবাহ বা আত্মীয় সম্পর্কের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। পাত্রপাত্রীর মধ্যে জানামতে এমন কোনো ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তা বা রক্তের সম্পর্ক নেই যাতে তাদের বিয়েতে আইনসম্মত বাধা আছে।
পাত্র-পাত্রী সাবালক
বিয়ের জন্য পাত্র-পাত্রীকে অবশ্যই সাবালক হতে হবে। পাত্র-পাত্রী যদি সাবালক না হয় তবে বিবাহ আইনত বৈধ হবে না।
এই ঘোষণা সম্পন্ন হওয়ার কমপক্ষে চারদিন পর গির্জার যাজক বিয়ের আবেদনকারীকে একটি সার্টিফিকেট দেবেন। সেই সার্টিফিকেট জারির দুই মাসের মধ্যে বিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে।
বিশেষ বিবাহ আইন
১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ শাসনামলের ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশে বিশেষ বিবাহ অনুষ্ঠিত হওয়ার নিয়ম চালু রয়েছে। যেকোনো ধর্মের মানুষই ‘বিশেষ বিবাহ আইন ১৮৭২’ অনুযায়ী অন্য যেকোনো ধর্মের মানুষকে বিশেষ বিবাহ আইন মেনে বিয়ে করতে পারবেন। এমনকি যেসব ব্যক্তি মুসলিম, হিন্দু, খ্রিষ্টান, ইহুদি, পারসি, বৌদ্ধ, শিখ বা জৈন ধর্ম গ্রহণ করেননি, তাদের মধ্যেও এ বিয়ে সম্পন্ন হতে পারে।
সমাজ ও সংস্কৃতির কারণে অনেকেই বিয়ের ক্ষেত্রে নিজ ধর্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও অনেকেই ভালোবাসার মানুষ হিসেবে পছন্দ করছেন ভিন্ন ধর্মের মানুষটিকে। তাদের জন্যই সাধারণত বিশেষ বিবাহ আইনের প্রচলন ঘটে। তবে চাইলেই এ বিয়ে সবাই করতে পারবেন না। এর জন্য মানতে হবে কিছু শর্তÑ
ক. এ আইনে বিয়ের সময় বিয়ের পক্ষগণের মধ্যে কারোরই কোনো জীবিত স্বামী বা স্ত্রী থাকতে পারবে না
খ. বিয়ে করতে ইচ্ছুক পুরুষ ব্যক্তির বয়েস ২১ বছর এবং নারীর বয়েস ১৮ বছর পূর্ণ হতে হবে
গ. পক্ষগণ রক্ত সম্পর্কে বা বৈবাহিক সম্পর্কে সম্পর্কযুক্ত হতে পারবেন না। যাতে তাদের একজনের ওপর প্রযোজ্য আইন দ্বারা ওই বিবাহ অবৈধ হতে পারে
ঘ. বিয়ের জন্য দুই পক্ষের মধ্যে যেকোনো একটি পক্ষ রেজিস্ট্রারের কাছে ১৪ দিন আগে বিয়ের নোটিশ পাঠাবে। যদি এ সময়ের মধ্যে কেউ আপত্তি না করে, তবে বিয়ে সম্পন্ন করা যাবে
ঙ. এ ধরনের বিশেষ বিয়ে সম্পন্ন করতে হবে রেজিস্ট্রার এবং ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষরদানকারী তিনজন সাক্ষীর সামনে। সেইসঙ্গে স্বাক্ষরদানের পর ওই হলফনামা নোটারি পাবলিক কর্তৃক ‘নোটরাইজড’ করতে হবে
চ. আইনের ২২ নম্বর ধারা অনুসারে, সহ-উত্তরাধিকারিত্বের ওপর কতিপয় বিয়ের ফলাফল হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ বা জৈন ধর্মাবলম্বী কোনো যৌথ পরিবারের কোনো সদস্যের এ আইন মোতাবেক বিয়ে হলে অনুরূপ পরিবার থেকে তার বন্ধন ছিন্ন হয়েছে বলে গণ্য হবে।
ছ. বাংলাদেশের কোনো মুসলিম, খ্রিষ্টান, ইহুদি, পারসি, বৌদ্ধ, শিখ বা জৈন নন বা তাদের একজন যেকোনো একটি বা অন্য ধর্মে বিশ্বাসী তাদের মধ্যে বিয়ের ব্যবস্থা করতে হলে বিশেষ বিবাহ আইনের অধীন উপযুক্ত বিবাহের ক্ষেত্রে ধর্ম ত্যাগ করা অত্যাবশ্যক। দুই পক্ষই ধর্ম ত্যাগ না করলে বিয়েটি বাতিল বলে গণ্য হবে। তবে ইসলাম ধর্মের ক্ষেত্রে মুসলিম কোনো ব্যক্তি ইচ্ছে করলে অন্য ধর্মের কোনো ব্যক্তিকে মুসলিম আইন অনুযায়ীই বিয়ে করতে পারেন।
জ. এ আইনের বিধানে যেকোনো ধরনের মিথ্যা বর্ণনা দেওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আবেদনকারী যদি বাস্তবে ধর্ম ত্যাগ না করে থাকেন, সে ক্ষেত্রে ধরা হবে যে, তিনি মিথ্যা বর্ণনা দিয়েছেন
ঝ. এ ধরনের বিয়ের ফলে বেড়ে উঠছে নতুন একটি প্রজন্ম। যারা উত্তরাধিকার সূত্রে কোনো নির্দিষ্ট ধর্মীয় পরিচয় বহন করছে না। এই উত্তরাধিকারীদের মধ্যে আবার কেউ কেউ একটি ধর্ম বেছে নিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সম্পত্তি বণ্টনের জন্য কোনো আইন নেই
ঞ. এ আইনের অধীন বিয়ের ফলে জন্মগ্রহণকারী সন্তান যদি এ আইনের অধীনই বিয়ের ইচ্ছে পোষণ করেন, তবে তার পিতা বিয়ের ক্ষেত্রে যে আইনে রক্ত সম্পর্কীয় ও বৈবাহিক সম্পর্কীয় বাধার সম্মুখীন ছিলেন, সে আইন এবং এ আইনের ২ ধারা তার ওপর প্রযোজ্য হবে
ট. হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ ও জৈন ধর্মে বিশ্বাসী কোনো ব্যক্তি, যিনি এ আইনের অধীন বিয়ে করেছেন, তার সম্পত্তির এবং এ বিয়ের ফলে জাত সন্তানের সম্পত্তির উত্তরাধিকার ‘উত্তরাধিকার আইন, ১৯২৫’ অনুযায়ী নিয়ন্ত্রিত হবে।
সরকারিভাবে এমন বিয়ে হওয়ার একমাত্র স্থান পুরান ঢাকার পাটুয়াটুলীতে। তবে যারা জানে না, তারা প্রথমে কোর্টে যান। এখানে বিয়ে হলেও ডিভোর্স করানো হয় না। ওটা কোর্টেই করতে হয়।
এ ধরনের বিশেষ বিয়েতে অবশ্যই লাগবে দুই কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি এবং জাতীয় পরিচয় পত্রের একটি ফটোকপি। যারা এরকম বিশেষ বিয়ে করার পরিকল্পনা করছেন, তারা অবশ্যই এই দু’টি জিনিস আর বিয়ের সাক্ষী নিতে ভুলবেন না যেন।
স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্টের অধীন বিয়ে করতে ইচ্ছুক হলে পাত্র এবং পাত্রীকে অবশ্যই প্রথমে একজন আইনজীবীর শরণাপন্ন হতে হবে। বিশেষ বিবাহ আইনের প্রক্রিয়া কিছুটা জটিল এবং সময় সাপেক্ষে। তবে এই বিষয়ে একজন দক্ষ আইনজীবী অত্যন্ত দ্রুততার সাথে এবং খুব সহজে আপনাকে আপনার লক্ষে পৌঁছে দিতে পারেন। এক্ষেত্রে বিশ্বস্ত একজন দক্ষ আইনজীবী আপনার কাজগুলো সহজ করে তুলতে পারে যা আপনার সময় ও হয়রানীর পরিমাণ কমিয়ে দিবে।
বিশেষ বিবাহ আইনে বিয়ের সংখ্যা ও পরিমাণ দিন দিন বেড়েই চলছে এর অন্যতম কারণ হলো এই আইন অনুযায়ী বিবাহ করতে তেমন বেশি ঝামেলা পোহাতে হয় না। ধর্ম ও নাম পরিবর্তন না করেও এই আইন অনুযায়ী দু’জন ভিন্ন ধর্মের প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি ‘বিশেষ বিবাহ আইন, ১৮৭২ [সংশোধিত ২০০৭] অনুযায়ী বিয়ে করতে পারেন।