ঈশা খাঁর দ্বিতীয় রাজধানী : মোশাররফ হোসেন

28 Jan 2025, 02:49 PM অন্যান্য শেয়ার:
ঈশা খাঁর দ্বিতীয় রাজধানী : মোশাররফ হোসেন


কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ উপজেলায় প্রাচীন জনপদে জঙ্গলবাড়ির অবস্থান। ১৬ শতকের শেষ দিকে এখানেই গড়ে উঠেছিল বাংলার বার ভূঁইয়াদের অন্যতম প্রধান ঈশা খাঁর দ্বিতীয় রাজধানী।

ঈশা খাঁর পিতামহ শ্রী ভাগীরথী অযোদ্ধা থেকে বাংলায় এসে সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদের অধীনে দেওয়ানি পদে চাকরি নেন এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে বসতি স্থাপন করেন। শ্রী ভাগীরথীর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র শ্রী কালীদাস গজদানী দেওয়ানি লাভ করেন। শ্রী কালীদাস গজদানী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে সোলায়মান খান নাম ধারণ করেন। পরবর্তীকালে সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদের কন্যাকে বিয়ে করে সরাইলের জমিদারি লাভ করেন। ১৫২৯ খ্রিাষ্টাব্দে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে ঈশা খাঁ জন্ম গ্রহণ করেন। সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদের মৃত্যুর পর সোলায়মান খান নিজেকে বৈধ উত্তরাধিকারী দাবি করে দিল্লির আফগান শাসকদের আনুগত্য মানতে অস্বীকার করেন।

১৫৫৪ খ্রিষ্টাব্দে শেরশাহের মৃত্যুর পর তার পুত্র ইসলাম শাহ দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেই বাংলাকে আফগান শাসনের অধীনে নেওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত নেন এবং সোলায়মান খানের বিরুদ্ধে সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেন। আফগান বাহিনীর সাথে যুদ্ধে সোলায়মান খান পরাজিত ও নিহত হন। যুদ্ধে বিজয়ী আফগান বাহিনী সোলায়মানের দুই পুত্র ঈশা খাঁ ও ইসমাইল খাঁকে বন্দি করে ইরানি বণিকদের কাছে দাস হিসেবে বিক্রি করে দেয়। ১৫৫৫ খ্রিষ্টাব্দে আফগান শাসনের অবসান হলে ঈশা খাঁর চাচা কুতুব খান ইরানি বণিকদের কাছ থেকে অর্থ পরিশোধ করে ঈশা খাঁ এবং ইসমাইল খাঁকে মুক্ত করে আনেন। ঈশা খাঁ দেশে ফিরে এসে তাঁর চাচার সহযোগিতা নিয়ে পিতার জমিদারি ফিরে পান। ১৫৮৩ খ্রিষ্টাব্দে নারায়ণগঞ্জের খিজিরপুরে মুঘল সুবেদার শাহবাজ খানের সৈন্যবাহিনীর সাথে ঈশা খাঁর যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে খিজিরপুর দুর্গ ও অস্ত্রাগার ঈশা খাঁর হাতছাড়া হয়ে যায়। ফলে তিনি তাঁর রাজধানী সোনারগাঁও থেেেক কিশোরগঞ্জ জেলার জঙ্গলবাড়িতে সরিয়ে নেন। কিশোরগঞ্জ জেলার জঙ্গলবাড়ি এলাকায় তখন কুচ-রাজা ও রঘু-রাজার বাড়ি ছিল। ঈশা খাঁর আগমনের সংবাদ শুনে কুচ-রাজা ও রঘু-রাজা ভীত হয়ে পড়েন এবং সপরিবারে তারা দুজনই প্রাসাদ ত্যাগ করে অনত্র চলে যান। ঈশা খাঁ তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে জঙ্গলবাড়িতে উপস্থিত হন।

১৫৮৫ খ্রিষ্টাব্দে জঙ্গলবাড়ি এলাকায় কুচ-রাজার পরিত্যক্ত বাড়ির পশ্চিম দিকে বসবাসের জন্য বাড়ি, মসজিদ ও দুর্গ নির্মাণ করে ঈশা খাঁ দ্বিতীয় রাজধানী স্থাপন করেন।

ঈশা খাঁ নির্মিত প্রায় সাড়ে চারশত বছর প্রাচীন মসজিদ, পারিবারিক কবরস্থান, বসতবাড়ি ও কাচারি ভবনের অংশবিশেষ এখনো কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

ঈশা খাঁর বসতবাড়িটির পূর্বাংশে কাচারিভবনের একটি অংশ টিকে আছে। জানা যায়, জঙ্গলবাড়ির কাচারিভবনে সে-সময় দরবার হলসহ মোট ২০টি কক্ষ ছিল। কাচারিভবনের দক্ষিণ পাশের ১৫টি কক্ষসহ বড়ো একটি অংশ ধ্বংস হয়ে গেছে। উত্তর পাশের অংশে দরবার হলের কিছু অংশসহ এখনও ৫টি কক্ষ অবশিষ্ট রয়েছে। উত্তর পাশের অবশিষ্ট কক্ষগুলোর পূর্বদিকে টানা লম্বা বারান্দা এবং বারান্দাসংলগ্ন ৭টি দরজা দৃশ্যমান। কয়েক বছর আগে থানা নির্বাহী কর্মকর্তার উদ্যোগে দরবার হলের একটি কক্ষে জাদুঘর ও গ্রন্থাগার করার চেষ্টা করা হয়েছিল।

কাচারিভবনের পেছনেই জঙ্গলবাড়ির অন্দরমহল। সে-সময় অন্দরমহলের চারপাশে দেয়াল ছিল। এখনো কাচারিভবন ও অন্দরমহলের মাঝখানে একটি উঁচু দেয়ালের অংশবিশেষ টিকে আছে। অন্দরমহলে ঢোকার সময়ে গোলাকৃতির স্থাপনা চোখে পড়বে। একসময়ে অন্দরমহলে ৪০টি কক্ষ ছিল। এখন মাত্র ৬টি কক্ষ অবশিষ্ট আছে। বাকি সব ধ্বংস হয়ে গেছে।

অন্দরমহলের পূর্ব পাশে এবং কাচারিভবনের উত্তর পাশে তিন গম্বুজবিশিষ্ট একটি প্রাচীন মসজিদ এখনো ভালো অবস্থায় রয়েছে। মসজিদটির পূর্ব পাশের দেয়ালে ৩টি এবং উত্তর-দক্ষিণে একটি করে দরজা রয়েছে। মসজিদটির ভেতরের দেয়ালে ৩টি মেহরাব রয়েছে। মসজিদটির উত্তর পাশে ৫টি প্রাচীন কবর রয়েছে। মসজিদের দক্ষিণ পাশে অদূরে আছে জিন্দা বিবির কবর। কাচারিভবন ও মসজিদের পূর্ব দিকে ঈশা খাঁর পারিবারিক কবরস্থান। এখানে দুটি প্রাচীন কবর বা সমাধি রয়েছে। ধারণা করা হয়, প্রাচীন কবর দুটি ঈশা খাঁর রাজত্বকালে ষোল শতকের মাঝামাঝি সময়ের। পারিবারিক কবরস্থানের পূর্ব দিকে একটি খাল নরসুন্দা নদীর সাথে সংযুক্ত। এই খাল দিয়েই যাতায়াতের পথ ছিল।

করিমগঞ্জ থেকে ৩৩ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে এগারোসিন্দু এলাকায় একটি দুর্গ নির্মাণ করেন। দুর্গটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেলেও একটি প্রাচীন কবর ও ইটের ঢিবি দুর্গের চিহ্ন বহন করছে। জনশ্রুতি আছে এগারোসিন্দু দুর্গের কাছাকাছি কোনো এক স্থানে মুঘল সেনাপতি মানসিংহের সাথে ঈশা খাঁর যুদ্ধ হয়েছিল।

কিশোরগঞ্জের অনেক স্থানেই ঈশা খাঁর জমিদারি ছিল। তিনি এবং তাঁর পরবর্তীবংশধরেরা প্রজাকল্যাণে অনেক জায়গা দান করে গেছেন। এরমধ্যে কিশোরগঞ্জ সদরে শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দান ও পাগলা মসজিদ অন্যতম। পাগলা মসজিদটির জায়গা ঈশা খাঁর ষষ্ঠ বংশধর আয়েশা দাদ খান দান করেন।

ঈশা খাঁর জঙ্গলবাড়ি ও এগারোসিন্দু দুর্গ দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন। বেশ কয়েক বছর আগে সরকারের প্রতœতাত্ত্বিক অধিদপ্তর ঈশা খাঁর জঙ্গলবাড়ি সংস্কার করার লক্ষ্যে নয় একর জমি অধিগ্রহণ করে। হ

লেখক : গবেষক, লেখক এবং টেলিভিশন অনুষ্ঠান নির্মাতা