মীর জুমলার তিনটি জলদুর্গ : মোশাররফ হোসেন

26 Feb 2025, 01:15 PM অন্যান্য শেয়ার:
মীর জুমলার তিনটি জলদুর্গ : মোশাররফ হোসেন


বাংলার সুবেদার মীর জুমলা ১৪৯১ খ্রিষ্টাব্দে পারস্যের ইস্পাহানের আর্দিস্থানে জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যকালে তার নাম ছিল মুহাম্মদ সাঈদ। ভাগ্য অন্বেষণে যুবক বয়সে এক ঘোড়া ব্যবসায়ীর অধীনে চাকরি নেন। ঘোড়া ব্যাপারী ভারতের গোলকু-াতে ঘোড়া রপ্তানি করতেন। ঘোড়া ব্যাপারীর সাথে রপ্তানিকাজে ১৬১৫ খ্রিষ্টাব্দে ভারত গোলকু-া রাজ্যে আসেন। অতঃপর গোলকু-া অঞ্চলের এক হীরক ব্যবসায়ীর অধীনে চাকরি নেন। কিছুকাল পর তিনি নিজেই হীরক ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসা বাণিজ্য করার পাশাপাশি তিনি রাজ্যের উচ্চপদস্থ প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ রাখতেন এবং বিভিন্ন সময়ে তাদের উপহার প্রদান করতেন। একপর্যায়ে তিনি গোলকু-া রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ বন্দর মাছলিপাট নামের প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি লাভ করেন। গোলকু-া রাজ্যের সুলতান আব্দুল্লাহ কুতুব শাহ কর্মদক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে মুহম্মদ সাঈদকে রাজ্যের উজির পদে নিয়োগ দেন। বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতার কারণে কিছু দিনের মধ্যেই তিনি সুলতানের ঘনিষ্ঠ সহচর হয়ে ওঠেন। মীর জুমলার সুখ্যাতি ও প্রভাব প্রতিপত্তি রাজ্যে ছড়িয়ে পড়লে তার প্রতি সুলতানের সন্দেহ তৈরি হয় এবং এক পর্যায়ে সুলতানের সাথে তার ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়। মীর জুমলার বীরত্বে ও কৌশলে গান্দকোট বিজয়ের গল্প শুনে মুঘল সম্রাজ্যের দাক্ষিণাত্যের সুবেদার শাহজাদা আওরঙ্গজেব তাকে মুঘল সাম্রাজ্যের রাজকর্মকর্তার চাকরির প্রস্তাব দিলে মীর জুমলা গোলকু-া রাজ্যের উজিরের চাকরি ছেড়ে দেন এবং মুঘলদের চাকরি গ্রহণ করেন। তিনি সুবেদার আওরঙ্গজেবের অনুগত ছিলেন। মুঘল সম্রাট শাহজাহান অসুস্থ হলে পুত্রদের মধ্যে যখন ক্ষমতার লড়াই শুরু হয়। মীর জুমলা তখন শাহজাদা আওরঙ্গজেবের পক্ষ অবলম্বন করেন। আওরঙ্গজেব সিংহাসনে বসেই ভাই শাহ সুজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য মীর জুমলাকে প্রেরণ করেন। দায়িত্ব পেয়ে মীর জুমলা ১৬৫৯ খ্রিষ্টাব্দে খাজোয়ার যুদ্ধে শাহ সুজাকে পরাজিত করেন। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে শাহ সুজা বাংলা ছেড়ে আরাকানে আশ্রয় গ্রহণ করেন। মুঘল সম্রাজ্যের নতুন সম্রাট আওরঙ্গজেব সিংহাসনে আসন গ্রহণ করার পর ১৬৬০ খ্রিষ্টাব্দে মীর জুমলাকে বাংলার সুবেদার নিয়োগ করেন।

সুবেদার হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর মীর জুমলা সুবেহ বাংলার প্রশাসনিক কাঠামো সংস্কার করেন। প্রথমেই তিনি বাংলার রাজধানী রাজমহল থেকে ঢাকায় স্থানান্তর করেন। এসময়ে তিনি বৃহত্তর ঢাকায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইমারত নির্মাণ করেন। তিনি বাংলার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। নদীপথে শত্রুসেনা ও জলদস্যুদের প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে সতের শতকের মাঝামাঝি সময়ে বৃহত্তর ঢাকায় দুই নদীর পাড়ে তিনটি জলদুর্গ নির্মাণ করেন। বর্তমান নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর দুই তীরে একটি করে দুর্গ এবং মুন্সিগঞ্জের ইছামতি নদীর তীরে একটি দুর্গ নির্মাণ করেন।


সোনাকান্দা দুর্গ

মীর জুমলার শাসনামলের তিনটি দুর্গের মধ্যে দু’টি দুর্গ রয়েছে বর্তমান নারায়ণগঞ্জ জেলায়। একটি দুর্গের অবস্থান নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দর উপজেলায় শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব পাড়ে সোনাকান্দা গ্রামে। আয়তাকার দুর্গটি পূর্ব-পশ্চিমে ৯০ মিটার লম্বা এবং উত্তর-দক্ষিণে ৫৬ মিটার চওড়া। দুর্গটির বেষ্টনী দেয়াল ৩.১০ মিটার উঁচু এবং ১.১০ মিটার পুরু। দেয়ালের উপরের দিকে গোলা ছোঁড়ার জন্য অসংখ্য ছিদ্র রয়েছে। দুর্গের চার কোণে চারটি বুরুজ রয়েছে। বুরুজের দেয়ালেও গোলা ও তীর ছোঁড়ার জন্য বিভিন্ন আকৃতির ছিদ্র রয়েছে। দুর্গের পশ্চিম দেয়ালের মাঝ বরাবর কামান স্থাপনের জন্য নদীর দিকে মুখ করা একটি অর্ধ গোলাকৃতির তোপমঞ্চ রয়েছে। তোপমঞ্চের বেষ্টনী দেয়ালেও বিভিন্ন আকৃতির ছিদ্র রয়েছে। দুর্গের ভেতর থেকে সিঁড়ি বেয়ে তোপমঞ্চে উঠতে হয়। দুর্গটির উত্তর দিকে একটি বিশাল প্রবেশদ্বার রয়েছে।


হাজিগঞ্জ দুর্গ

শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম পাড়ে নারায়ণগঞ্জ জেলার হাজিগঞ্জে রয়েছে অন্য দুর্গটি। এক-সময়ে এলাকাটির নাম ছিল খিজিরপুর। একারণে হাজিগঞ্জ দুর্গের অন্য নাম খিজিরপুর দুর্গ। চারদিকে দেয়ালবেষ্টিত এই দুর্গেও অর্ধ গোলাকৃতির তোপমঞ্চ রয়েছে। দেয়াল ও তোপমঞ্চে গোলা ছোঁড়ার জন্য অসংখ্য ছিদ্র রয়েছে। তোপমঞ্চের বাঁদিকে দুর্গের ভেতরে উঁচু একটি টাওয়ার ছিল। প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত টাওয়ারটির কিছু অংশ এখনো টিকে আছে। এই দুর্গের প্রবেশ তোরণটি বেশ উঁচুতে। ডিম্ব আকৃতির দুর্গটিতে সিঁড়ি বেয়ে তোরণে উঠতে হয় এবং সিঁড়ি বেয়ে দুর্গের ভেতরে নামতে হয়। উল্লেখ্য যে, মুঘল সুবেদার মীর জুমলার এই দুর্গ নির্মাণের অনেক আগে থেকেই খিজিরপুরে ঈশা খাঁর দুর্গ ও অস্ত্রাগার ছিল। মুঘল সুবাদার শাহবাজ খানের সৈন্যদের সাথে ১৫৮৩ খ্রিষ্টাব্দে খিজিরপুরে ঈশা খাঁর যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে ঈশা খাঁ পরাজিত হলে মুঘল সৈন্যরা খিজিরপুর দুর্গ ও অস্ত্রাগার দখল করে নেয়।


ইদ্রাকপুর দুর্গ

মুন্সিগঞ্জ জেলা শহরের পুরানো কাচারি এলাকায় ইছামতি নদীর তীরে ইদ্রাকপুর দুর্গটি নির্মাণ করা হয়েছিল। ইছামতি নদীটি এখন আর সেখানে নেই। উত্তর দক্ষিণে লম্বা ইদ্রাকপুর দুর্গটির মোট আয়তন ৪৫৬৫ বর্গ মিটার। দুর্গের চারদিকে ৬ মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট ১ মিটার পুরু ইটের সীমানা দেয়াল রয়েছে। দুর্গের ভেতরে মাঝখানে একটি গোলাকার মঞ্চ রয়েছে। মাটি থেকে কয়েক মিটার উঁচু এই মঞ্চে ওঠার জন্য দুর্গের ভেতর থেকে প্রশস্ত সিঁড়ি রয়েছে। মঞ্চটির চারদিকে দেয়াল রয়েছে। গোলাকার মঞ্চ ও দুর্গের সীমানা দেয়ালের উপরের দিকে তোপ ও তীর ছোঁড়ার জন্য অসংখ্য ছিদ্র রয়েছে। মঞ্চের উপর থেকে গোলা ছোঁড়ার জন্য দেয়ালের গায়ে অসংখ্য ফোকর বা ছিদ্র রয়েছে। মঞ্চ থেকে সরাসরি বাইরে বের হওয়ার জন্য আরো একটি ছোটো সিঁড়ি ও দরজা রয়েছে।

মুঘল আমলে নির্মিত নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনাকান্দা দুর্গ ও হাজিগঞ্জ দুর্গ এবং মুন্সিগঞ্জ জেলার ইদ্রাকপুর দুর্গ তিনটি ইট, চুণ ও সূরকি দিয়ে মুঘল স্থাপত্য রীতিতে নির্মিত। একাধিক ঐতিহাসিক তাদের লেখায় তিনটি দুর্গকে গুরুত্বপূর্ণ ‘ট্রায়াঙ্গল অব ওয়াটার ফোর্ট’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। মুঘল শাসনামলে সুবেহ বাংলার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় দুর্গ তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।

লেখক : গবেষক, লেখক এবং টেলিভিশন অনুষ্ঠান নির্মাতা