বর্তমান প্রজন্মের লোকগানের জনপ্রিয় শিল্পী ডলি মণ্ডল। ছেলেবেলা থেকেই বাউলগানের চর্চা করছেন। ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে গানের রিয়েলিটি শো ম্যাজিক বাউলিয়ানায় নাম লেখান। তারপর থেকেই তার সংগীতভুবনে পথচলা শুরু। তার অসাধারণ সুরেলা কণ্ঠের মাধুর্য দিয়ে গান গেয়ে শ্রোতাদের মুগ্ধ করে রেখেছেন। এরপর ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে একই অনুষ্ঠানে অ্যাসিস্ট্যান্ট মেন্টর হিসেবে কাজ করেন। এটা নিঃসন্দেহে তার জন্য একটা বড়ো পাওয়া। এখন নিয়মিত লালন সাঁইজির বাণী পরিবেশন করছেন। টিভি ও স্টেজ শো’র ব্যস্ততার পাশাপাশি মৌলিক গান প্রকাশ করেছেন নিয়মিত। ধানমন্ডি লেকের মনোরম পরিবেশে আনন্দ-আড্ডায় তার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা হয়। এবারের আনন্দভুবন প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে ডলি মণ্ডলকে নিয়ে থাকছে বিস্তারিত। লিখেছেন শহিদুল ইসলাম এমেল...
বর্তমান প্রজন্মের জনপ্রিয় লোকগানের শিল্পী ডলি মণ্ডলের বাড়ি কুষ্টিয়ার মহিষাডাঙায়। সংগীতের হাতেখড়ি তার দাদু গুরু বাউল সাধন শাহ ফকিরের কাছে। উনি একদিন তাদের বাড়িতে এলেন। আসার পর তাদের ঘরের মধ্যে বসেন। সঙ্গে ওনার একটা দোতারা ছিল। সেই দোতারাটা ডলি আর তার বড়ো বোন পলি টুংটাং করে বাজাচ্ছিলেন। সেই মুহূর্তে তার বাবা আসেন। বাবা এসে তাদের গানের প্রতি আগ্রহ দেখেন। তখন দাদু তার বাবা-মাকে সামনে রেখে গান শেখানোর জন্য বাক্য দেন। তারপর থেকেই তার বাবা সমাজের সব কিছু বিসর্জন দিয়ে সবার লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সয়ে তাদের এই গানের জগতে রেখেছেন এবং গান শিখিয়েছেন। তার বাবাও ছিলেন একজন মজ্জুবি সাধক। সেই সময়ে দাদু তাদের একটা গানের একটুখানি শিখিয়ে দিয়েছিলেন। গানের কথা ‘অজানা এক নদীর স্রোতে, আমি হারিয়েছি সাথি...।’ সেই গানটি তারা মাঝে মাঝেই গাইতেন। এর মাঝে একদিন দাদু দুই বোনকে এক সাধুসঙ্গে নিয়ে যান। ওখানে গান গেয়ে তারা সম্মানীও পেয়েছিলেন। ডলি গুরুর কাছে গান শিখতেন আর মাঝেমধ্যে বিভিন্ন সাধুসঙ্গে যেতেন। সেখানে পালাগান গাইতেন। বিভিন্ন জায়গায় ছোটো ছোটো স্টেজ শো-তে বাবাও তাকে নিয়ে যেতেন। ডলি মণ্ডলের সর্বপ্রথম হারমোনিয়ামে হাতে খড়ি তারই এলাকার একজন ওস্তাদ মোতালেব মাস্টারের কাছে। তার কাছে শাস্ত্রীয় সংগীত শিখেছেন। এলাকায় আরো একজন শিক্ষকের কাছেও সংগীতে তালিম নিয়েছেন। এরপর এসএসসি শেষ করে ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকায় এসে আগারগাঁও সরকারি সংগীত কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকেই সংগীত বিষয়ে
স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। কলেজে পড়া অবস্থায় যোগাযোগ করেন গুরুজি শফি মন্ডলের সঙ্গে। গুরুজি শফি মন্ডলের সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়ার পর থেকে পালাগান ছেড়ে দিয়ে লালন সাঁইজির বাণী পরিবেশন করছেন।
তিনি তার মেধা-মনন ও অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে আজকের এই অবস্থানে আসতে পেরেছেন। তার সুরেলা কণ্ঠের জাদুতে হাজারো ভক্ত-স্রোতার হৃদয়ে জায়গা করে নিতে সক্ষম হয়েছেন।
কোন ধরনের গান গাইতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, এমন প্রশ্নের জবাবে ডলি মণ্ডল বলেন, “বাউল গানেই নিজেকে সঁপে দিয়েছি। বাউল গানের সঙ্গে আমার আত্মার সম্পর্ক সেই ছেলেবেলা থেকেই। ‘যা আছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে তা আছে মানব ভাণ্ডে।’ পাঞ্জু সাঁই একটা বাণীতে বলেছেন, ‘বস্তুতে ঈশ্বর আছেন, কররে তার উল, যে খোঁজে মানুষে খোদা সেই তো বাউল...।’ তো সেই সুন্দরের অনুসন্ধানের চেষ্টা করে চলেছি সবসময়।”
ডলি মণ্ডলের এবারের ঈদে নতুন কিছু মৌলিক গান প্রকাশিত হয়েছে। তিনি মূলত সাঁইজির বাণী কণ্ঠে ধারণ করে থাকেন। সাঁইজির গানের পাশাপাশি বেশকিছু মৌলিক গান করেছেন। আইকে মিউজিক স্টেশন থেকে নতুন একটি মৌলিক গানসহ আরো বেশকিছু মৌলিক গান আসছে বলে জানালেন তিনি।
বৈশাখ নিয়ে পরিকল্পনা কী, সারাদিন কী করবেন ? জানতে চাইলে বলেন, ‘পয়লা বৈশাখের দিন স্টেজ শো ও টেলিভিশন শো নিয়ে সারাদিন ব্যস্ত থাকবো ইনশাল্লাহ।’
ডলি মণ্ডল ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে সংগীত রিয়েলিটি শো ম্যাজিক বাউলিয়ানায় সেরা দশে উত্তীর্ণ হন। সেই সময়ে হয়ত প্রথম হওয়ারও একটা স্বপ্ন ছিল। সেরা দশ মানেই টানটান উত্তেজনা। আপনার সেরা দশ হওয়ার অনুভূতি কেমন ছিল ? জানতে চাইলে বলেন, ‘আমি ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে সংগীত রিয়েলিটি শো ম্যাজিক বাউলিয়ানায় অংশগ্রহণ করার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করি। আগ্রহ বলতে আসলে সবারই একটা ইচ্ছে থাকে নিজেকে টেলিভিশন স্ক্রিনে দেখার। তাছাড়া এত বড়ো একটা প্ল্যাটফর্ম সেখানে সবাই সবাইকে চিনবে জানবে। যারা শিল্পী তাদের এরকম আশা থাকা স্বাভাবিক। আমার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ছিল না। আমারও ইচ্ছে ছিল প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার। তখন আমি গুরুজি বাউল শফি মণ্ডলের কাছে শিখছি। রিয়েলিটি শো-তে নাম দেবো সেই ইচ্ছে থেকে গুরুজিকে জিজ্ঞেস করলাম, আমি একটি রিয়েলিটি শো-তে যেতে চাই। শুনে গুরুজি একপর্যায়ে আমাকে নিষেধই করলেন। তিনি বললেন, [আসলে ছেলেবেলা থেকেই স্টেজ হচ্ছে আমার আসল জায়গা। স্টেজে আমি খুব স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি] তুমি একসময় এমনিতেই অনেক পপুলারিটি পাবে। তারপরও আমার মন মানেনি, আমি একপর্যায়ে রিয়েলিটি শো-তে নাম দিই। আমি সেরা দশে ছিলাম। এর দুই বছর পর ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে আমি ম্যাজিক বাউলিয়ানাতে অ্যাসিস্ট্যান্ট মেন্টর হিসেবে কাজ করার সুযোগ পাই। এটা আমার কাছে একটা বড়ো পাওয়া। এজন্য আল্লাহর কাছে অনেক অনেক শুকরিয়া।’
অনেকে মনে করেন লোকগান আগের মতো জনপ্রিয়তা পাচ্ছে না। এখন যেসব লোকগান হচ্ছে তা মাটি ও মানুষের কাছে যাচ্ছে না। আপনি কী মনে করেন ?
‘আমি তো একদম শেকড়টা আঁকড়ে আছি। আসলে নিজের মেন্টালিটির ওপর নির্ভর করবে আপনি কীভাবে নিজেকে উপস্থাপন করবেন। আমি লোকগানে আমার শেকড়ের গন্ধ পাই। আমরা যারা বাঙালি, আমরা যতই নতুন কৃষ্টি-কালচারের সঙ্গে নিজেকে সংযুক্ত করি না কেন দিনশেষে আমাদের মাটির গন্ধটা একটু অন্যরকমভাবেই সবাইকে টানে।
আমরা যারা মা-মাটির কথা বলি, আমরা যারা মাছে ভাতে বাঙালি, আমাদের বাংলা সংস্কৃতি, বাংলা ঢোল, সবকিছু মিলিয়ে বাংলা লোকসংগীত আমাদের শেকড়ে মিশে আছে। আর আমি সেই শেকড় প্রতিনিয়ত ধরে রাখার চেষ্টা করছি, করে যাচ্ছি।’
আমাদের দেশে জারি-সারি, ভাটিয়ালি-ভাওয়াইয়া, মুর্শিদি, গম্ভীরা-সহ আরো নানা ধরনের লোকগান রয়েছে। লালন সাঁই, হাসন রাজা, শাহ আব্দুল করিম, আব্বাস উদ্দিন, আব্দুল আলীম, মমতাজ-সহ এরা নানা সময় নানা ধরনের লোকগান সৃষ্টি করেছেন এবং গেয়ে জনপ্রিয় হয়েছেন। বর্তমান প্রজন্মের শিল্পীরা তাদের কতটুকু কাছাকাছি আসতে পেরেছে বলে আপনি মনে করেন ? “আসলে এখন ইউটিউবের যুগ। বর্তমানে যারা আছে তারা অনেকেই [আমি সকলের কথা বলবো না] ইউটিউব ওস্তাদ হয়ে গেছে। আরে সংগীতটা হচ্ছে গুরুমুখী বিদ্যা। সংগীতের মাঠে নিজেকে সবসময় নিয়োজিত রাখতে হবে। বিশ্বাস করুন, অন্য কাজ আপনি সহজেই করতে পারবেন কিন্তু সংগীত এমনভাবে সাধনার একটা বিষয়, গুরুমুখী বিদ্যা ছাড়া এটা হবে না। এটা আমরা সবাই গুরুজনের মুখে শুনে থাকি। এটা আসলে আমিও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি। কারণ, গুরুর কাছে, গুরুজির নিদর্শন না পেলে সেই জিনিসটা তার মধ্যে আসবে না। হয়তো-বা তার কণ্ঠ ভালো হতে পারে। একটা গান সুরে তুলে সে গাইতে পারবে কিন্তু একটা গানের কথা তারপর কী বলতে চাচ্ছে কী মেসেজ দিতে চাচ্ছে সেটা না বুঝে গাওয়া ঠিক নয়। একজন গুরুর কাছে গেলে সেটা উপলব্ধি করে গাইলে সেই গানটার কালারই চেঞ্জ হয়ে যাবে। আমি এটা বিশ্বাস করি। এখনকার যুগে কেউ কেউ ইউটিউব থেকে গান তুলে গেয়ে ফেলছে। আমি সাজেস্ট করব একজন গুরু ধরে গুরুর কাছে আপনি শিক্ষা গ্রহণ করে তারপর গান গাওয়ার চেষ্টা করুন। ধরুন একটা বিল্ডিংয়ের নিচের ফাউন্ডেশন যদি ঠিক না থাকে তাহলে কিন্তু আপনি সেখানে ১০ তলা বিল্ডিং করতে পারবেন না। তাই সংগীতে শক্ত ফাউন্ডেশন গড়তে হলে আগে ক্লাসিকাল জানতে হবে। নিজের কণ্ঠস্বর তৈরি করতে হবে তারপর যে গানই করেন না কেন, কোনো অসুবিধা হবে না।”
সংগীত নিয়ে ভবিষ্যতে কাজ করার ইচ্ছা আছে ডলি মণ্ডলের। ছেলেবেলা থেকেই কিছু কাজ করে আসছেন। এখনো করছেন। তার বাবার একটা দরবার আছে, ওখানে ভবিষ্যতে একটা লাইব্রেরি করতে চান। শিশুদের শেখানোর জন্য ওখানে একটা একাডেমি করতে চান। যারা টাকা-পয়সার অভাবে শিখতে পারছে না, তাদের পাশে থাকতে চান। যতটুকু পারেন মানুষের কল্যাণে কাজ করতে চান।
ডলি মণ্ডল ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে মিশরে একটি সংগীত ফেস্টিভ্যালে যোগ দিয়েছিলেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মাধ্যমে। সেখানে বাংলাদেশসহ আরো অনেক দেশ অংশগ্রহণ করেছিল। সেখানে বিভিন্ন দেশের অনেক জনপ্রিয় শিল্পীদের সঙ্গে তার দেখা হয়। এর বাইরে বিভিন্ন দেশে বাউল গান পরিবেশন করেছেন।
ডলি মণ্ডলের সংগীত ক্যারিয়ারে ‘ভবের এই সংসারে’, ‘কী খেলা খেলিছ দয়াল’, ‘আজকে মরলে কালকে দুই দিন’, ‘রঙের এই দুনিয়া’, ‘মরণ তো আইবো না তোরে জিগাইয়া’, ‘আমলনামা’, ‘বিশ্বকারিগর’, ‘মন সহজে কি সহজ হবা’, ‘ছোট্টো মনের বাসনা’, ‘খেয়াপাড়ি’সহ আরো বেশকিছু গান প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া তার নিজের চ্যানেল ‘ডলি মণ্ডল অফিসিয়াল’ থেকে লালন সাঁইজির বেশ কয়েকটি বাণী প্রকাশিত হয়েছে। নিজের চ্যানেল থেকে নিয়মিত গান প্রকাশ করে যাবে বলে জানান তিনি।
আনন্দভুবনের পাঠকদের উদ্দেশ্য যদি কিছু বলুন-
‘আনন্দভুবন সবসময় আনন্দ দিয়ে থাকে। এটা পড়তে আমার খুব ভালো লাগে। আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞ যে, আমাকে আপনারা আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। সব মিলিয়ে আমার খুবই ভালো লাগছে আজকে আনন্দভুবনের একটা অংশ হতে পেরে। আর বিশেষ করে আমি যে আনন্দভুবনের দেখা পাব কল্পনাও করিনি। তবে, আপনারা যে, আমার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে আমাকে ডেকেছেন এজন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। সবাই ভালো থাকবেন।’
ছবি : জাকির হোসেন