ইউরোপের ১৫০ দিন -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

11 May 2021, 05:37 PM ভ্রমন শেয়ার:
ইউরোপের ১৫০ দিন -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

ভ্রমণ পর্ব-৩

[পূর্ব প্রকাশিতের পর]

বারগেনে আমাদের যে উদ্দেশ্যে আসা অর্থাৎ পড়াশোনা সেটা তখনও শুরু হওয়া বাকি, যদিও আমরা জেনে ছিলাম অগাস্টের ১২ তারিখ থেকে সেমিস্টার কার্যক্রম শুরু হবে কিন্তু বাস্তবে তা আরো কিছু দিন পিছিয়ে গেল, ইউনিভার্সিটির নোটিশ অনুযায়ী অগাস্টের ২৫ তারিখ থেকে সেমিস্টার শুরু হবে। যে-কারণে আমরা বেশকিছু জমানো দিন পেয়ে গেলাম যা আরামসে খরচ করা যাবে। তবে সেখানেও বিপত্তি-একে তো নতুন জায়গা তার ওপর খেয়ালি প্রকৃতি ; সে কি আর আমাদের কথামতো চলবে, মোটেই না। সুতরাং আমাদেরই তার মর্জিমতো সময় খরচের পরিকল্পনা সাজাতে হলো। এমনিতে সময়টি খুবই উপযোগী ছিল নরওয়ের আশেপাশের এক বা একাধিক প্রতিবেশী দেশের সাথে সাক্ষাৎ করে নেওয়ার, হতে পারতো সেটি পোল্যান্ড অথবা সুইডেন। ভেবেছিলামও সেইমতো তবে তা কাজে পরিণত করা যায়নি কারণ তখনও পর্যন্ত আমরা নরওয়ের অস্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে আমাদের পরিচয়টি হাতে পাইনি। এখানে একটু বলে নিই, নরওয়েতে যারা পড়াশোনা করতে আসেন তারা তাদের শিক্ষা কার্যক্রমের মেয়াদ অনুযায়ী একটি পরিচয়পত্র পেয়ে থাকেন যা স্থানীয় পুলিশ ডিপার্টমেন্ট ইস্যু করে থাকে। নরওয়েতে আমাদের থাকার মেয়াদ পাঁচ মাস, অবশ্য বারগেন কর্তৃপক্ষ আমাদের ছ’মাস মেয়াদের পরিচয় পত্র দিয়েছিল। এই পরিচয়পত্রটি মূলত সেনজেন ভিসার মতো কাজ করে, অর্থাৎ এটি থাকলে যে কেউ ইউরোপে সেনজেনভুক্ত দেশগুলো ভ্রমণ করতে পারে অনায়াসে। সপ্তাহান্তে অথবা অন্য কোনো ছুটিছাটায় টিকেট কেটে যেকোনো দেশে উড়াল দেওয়া খুবই মামুলি ব্যাপার, অনেকটা যেন ঢাকা-কক্সবাজার ট্যুরের মতো।

যা বলছিলাম, আমরা তখন আমাদের স্বাধীনতার সনদখানা [পরিচয়পত্র] পাইনি তাই যা কিছু প্লান-প্রোগ্রাম ছিল সবই নরওয়ে কেন্দ্রিক, বলা ভালো বারগেন কেন্দ্রিক। আগেই জানিয়ে ছিলাম, বারগেনে তিন ধরনের পাবলিক ট্রান্সপোর্ট চলে এবং সবই একটি টিকেটে চলাচল করা যায়, তাই অনেকটা ভাস্কো দা গামার মতো আমরা বেরিয়ে পড়তাম, যদি কিছু আবিষ্কার করা যায়। কখনো ঝর্না, কখনো সমুদ্রের খাড়ি, কখনো-বা কোনো নাম না জানা লেক, পোড়োবাড়ি অথবা নিতান্ত কিছুু না পেলে কোনো একটা মার্কেট প্লেসে গিয়ে ঘুরে-ফিরে আসা, এই ছিল আমাদের দৈনন্দিন রুটিন। তবে এই নিত্যকার রুটিনের সাথে নিয়মমাফিক আরেকটি বিষয় যুক্ত হলো, তা হচ্ছে প্রতিদিনের আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি জেনে নেওয়া। কারণ, আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতির ওপর নির্ভর করেই আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হতো যে, আমরা পথে বের হবো, না কাঁথা মুড়ি দিয়ে অলস সময়কে প্রশ্রয় দেব। তবে, সবসময় যে রৌদ্রোজ্জ্বল দিনই ঘুরে বেড়ানোর জন্য উপযোগী তা কিন্তু নয়, কখনও কখনও মেঘলা বা বৃষ্টিমুখর দিনও বেড়ানোর জন্য পরম কাক্সিক্ষত হয়ে থাকে। এমনি এক বৃষ্টিঝরা দিনে অনেকটা রণাঙ্গনে যাওয়ার বেশে আমরা বেরিয়ে পরলাম ঝর্না দেখবো বলে। খুব দূরে নয়, আমাদের আবাসস্থল থেকে মাত্র চারটে স্টেশন পর জায়গাটির নাম অর্গিল্যান্ড। অবশ্য সরাসরি ‘বিবানে’ যাওয়া যায় না, কিছুটা পথ বাসে যেতে হয়। ও আচ্ছা, ‘বিবান’ আবার কী জিনিস ? এটা হচ্ছে বারগেনের অত্যন্ত জনপ্রিয় বাহন লাইট ট্রেনের ডাক নাম। অবশ্য সকালটাতে যখন আমরা স্টেশনে অপেক্ষা করতাম ‘বিবান’র জন্য, তখন প্রায়ই আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অতি আপন লাল বাসের কথা মনে পড়ে যেত। যদিও ‘বিবান’ বা লাইট ট্রেন যাই বলি না কেন, এটি কোনো স্টুডেন্ট ট্রান্সপোর্ট নয়। তবে, সকাল ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে যাতায়াতকারী যাত্রীদের প্রায় ৯৫ভাগই বারগেন ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী।

সকাল সকাল আমি আর ফারজানা বেরিয়ে পড়লাম গন্তব্যের পথে, যেহেতু গন্তব্যটি আমাদের অজানা এবং খুব খ্যাত কোনো জায়গা নয়। তাই আবারও তানিয়ার সহায়তা নেওয়া। যদিও তানিয়াই আমাদের প্রস্তাব দিয়েছিল বেড়াতে নিয়ে যাবার। আগের দিন বেশ বৃষ্টি ছিল, সকালটাও ঝিরঝিরে বৃষ্টিকে ধরে রেখেছে, এরই মাঝে আমাদের বেড়াতে যাওয়া। শীতের পোশাক তো আছেই, যতটা পারা যায় পরে নিয়েছি, বাড়তি সাথি হলো বর্ষাতি। মাঝপথে তানিয়া আমাদের সারথি হলো আর বাকি পথটুকু আমরা বাসে গেলাম ঠিক কোন স্টপে নেমে ছিলাম মনে করতে পারছি না। কেননা, আমরা তিনজনেই গল্পে বেশ মশগুল ছিলাম। তানিয়া যেহেতু রয়েছেই পথপ্রদর্শক হিসেবে তাই আর সেদিকে নজর দেওয়ার প্রয়োজনও বোধ করিনি। বাধ্য অনুসরণকারীর মতো সে আমাদের যেখানে নামতে বলল, আমরা সেখানে নেমে গেলাম। এরপর বকিটা পথ পদব্রজে এগিয়ে গেলাম, প্রথমে মনে হলো আমরা একটি ছোটোখাটো পার্কে চলে এসেছি। খুব একটা সাজানো গোছনো এমন নয়, বেশ চড়াই-উৎড়াইসমৃদ্ধ মোটমোটি ঘন বনানী। ভেতরে ঢুকতেই অ্যাডভ্যাঞ্চারাস একটা অনুভূতি বোধ হলো, ঐযে ফেসবুকে যেমন এক্সপ্রেশন থাকে না feeling adventurous, অনেকটা সেইরকম। একে তো ঘন বন, গাছের ডাল-পালা আর পাতার দুর্ভেদ্য বর্ম ভেদ করে রোদ মাটি পর্যন্ত পৌঁছায় বলে মনে হয় না, তার ওপর টানা বৃষ্টিতে পথঘাট একদম পিচ্ছিল হয়ে আছে, খুব সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে। একটু এদিক-সেদিক হলেই আছাড় খাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। বেশ খানিকটা পথ যাওয়ার পর জলের মৃদু ছন্দ আমাদের কানে এল, আমরা শব্দের উৎস লক্ষ করে এগিয়ে গেলাম।

বারগেন শহরটি মূলত পাহাড় আর সমুদ্রের বেষ্টনীর মধ্যে থাকা একটি শান্ত আর ছিমছাম জনপদ। শহরজুড়ে কতশত জলাধার আর ঝর্নার ছড়াছড়ি তার ইয়েত্তা নেই। আমরা বাঙালিরা ঝর্না বলতে তো হাতের পাঁচ মাধবকুÐকেই চিনি বা বলা যায়, ধরাছোঁয়ার মধ্যে ওটিই আমাদের সম্বল, তাই বারগেন শহরে এই যত্রতত্র ঝর্না দেখে যে শুধু বিস্মিতই হই তাই নয়, কিছুটা ঈর্ষান্বিতও হচ্ছি। তবে বলতেই হবে, প্রকৃতি কিন্তু জানে কোথায় তার কদর, সেই বুঝে সেও সেখানে অকৃপণ। আগেই বলেছিলাম বারগেনবাসীর সৌন্দর্যবোধ আর প্রকৃতির প্রতি তাদের অপরিসীম আবেগের কথা, ভালোবাসার কথা। আর তাই প্রকৃতিও তার প্রতিদান দিচ্ছে প্রাণখুলে। ফিরে আসি অভিযান পর্বেÑ খুব বেশি পথ হাঁটতে হয়নি, এরই মধ্যে জলতরঙ্গ আমাদের দৃষ্টিগোচর হলো। আসলে এটিকে ঠিক ঝর্না বলা চলে না, ছোটোখাটো একটি শৈলপ্রপাত বলা যায়, হয়ত এটি ছুটে এসেছে কোনো এক ঝর্না থেকেই যার নাগাল আমাদের ধারে কাছে ছিল না ; তাই সেদিকে গেলাম না। প্রপাতের উৎসমুখ যেমন আমাদের অধরা ছিল, তেমনি এর শেষটিও ছিল অজানা। আমরা মূলত যাত্রাপথের পথিক হয়ে এর বয়ে চলা দেখছিলাম। প্রপাতটির উপর ছোট্ট একটি সেতু যা দিয়ে অনায়াসে এপার-ওপার করা যায়। আমরা সেতু পার হয়ে এগিয়ে গেলাম, এমনি তো ঘন সবুজের মাঝে রুপোলি জলের ছটা যেন একটু বেশিই ঝলকানি দিচ্ছে তার ওপর ছন্দময় ছুটে চলার মাদকতা তো রয়েছে, সব মিলিয়ে অদ্ভুত এক আবেশ, মনে হয় যেন এখানটাতে পৃথিবীর যান্ত্রিক সব কোলাহল হার মেনেছে। বারগেনে এসে আমার থেকে থেকে জীবনানন্দ দাশকে মনে পড়ে যাচ্ছে, ঠিক এখানে এসে যেমন মনে পড়ে গেল ‘পৃথিবীর কোলাহল সব ফুরিয়ে গেছে/ সেই শেষ ঘুম এসেছে নক্ষত্রের ভিড়ে / এখুনি তাদের আলো নিভে যাবে / পড়ে থাকবে অন্ধকার নিস্তব্ধ চরাচর।’ যা বলছিলাম আরকি, যান্ত্রিক কোলাহলের সাথে হার মেনেছে আমাদের প্রত্যাশার সীমানাও, বৃষ্টি তখনও ঝিরঝির ঝরে যাচ্ছে। যে-কারণে কোথাও দু’দণ্ড বসার জো নেই ; তাই পায়ে পায়ে এগিয়ে যাচ্ছি। সামনে কাঠের একটি অবয়ব দেখে থামলাম, এই নিসঙ্গ জঙ্গলে কে বনবাস নিল তার খোঁজ করতেই হয়। ছোট্ট এই কাঠের বাড়িটি আমাদের বেশ কৌত‚হলী করে তুলেছে, তাই কৌত‚হল মেটাতে আমরা বাড়িটির প্রবেশ দ্বার খোঁজ করছিলাম। কাছে এগুতেই একটানা যান্ত্রিক শব্দ কানে এল, যা সেই কাঠকুঠুরী থেকেই আসছিল, কৌত‚হল আরো বেড়ে গেল। অনেকটা সময় লেগেছে আমাদের ব্যাপারটা বুঝতে, তানিয়ার অবস্থাও এক্ষেত্রে আমাদের মতোই, আসলেই জিনিসটা কী ? যাহোক অবশেষে উদ্ধার হলো এটি একটি ওয়াটার মিল, যা কি না চলমান জলের স্রোতকে বেঁধে নিয়ে শক্তি উৎপাদনে ব্যস্ত। খুব মামুলি দেখতে হলেও জিনিসটা আমাকে আলোড়িত করেছে। শুধু প্রথম দেখছি বলে নয়, বরং নরয়োজিয়ানদের এই ভাবনাটা আমাকে আলোড়িত করেছে। যেখানেই হোক অথবা যত ছোটোই হোক কোনো ইতিবাচক সুযোগকেই অবহেলা করতে নেই। [চলবে]

ছবি : লেখক