আপনি যা বলছেন তার ওপরে আর কোনো সত্যি কথা নেই -ফারজানা করিম

25 Jan 2022, 03:16 PM সংবাদ উপস্থাপক শেয়ার:
আপনি যা বলছেন তার ওপরে আর  কোনো সত্যি কথা নেই  -ফারজানা করিম

টিভি সংবাদ উপস্থাপনার ক্ষেত্রে স্পষ্ট উচ্চারণ, সুন্দর বাচনভঙ্গি ও আকর্ষণীয় চেহারা এবং দর্শকপ্রিয়তা বা জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে হাতে গোনা যে ক’জন সংবাদ উপস্থাপক এগিয়ে আছেন একাত্তর টিভির ফারজানা করিম তাদের মধ্যে অন্যতম। দর্শকনন্দিত এই সংবাদ উপস্থাপকের বিস্তারিত আনন্দভুবনের পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো...




আনন্দভুবন : কেমন আছেন ?


ফারজানা করিম : ভালো আছি।


আনন্দভুবন : শুরুতেই জানতে চাই সংবাদ উপস্থাপক হয়ে ওঠার গল্পটা কী ছিল ?


ফারজানা করিম : আমি যখন অনার্স করছিলাম তখনই বিটিভির চট্টগ্রাম কেন্দ্রে অডিশন দিয়ে টিকে যাই। বছরটা এই মুহূর্তে মনে করতে পারছি না। যেহেতু আমি চট্টগ্রামের মেয়ে তাই ওখানেই সংবাদ পাঠ করতে শুরু করি। এরপর আর বন্ধ হয়নি। তারপর পড়ালেখা শেষ হওয়ার পর আমি একটা অর্গানাইজেশনে মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ হিসেবেও চাকরি করতাম। এরপর ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দে চ্যানেল আইতে সিভি জমা দিই। চ্যানেল আইতে আমার তিনটা অডিশন হয়। আমি তিনটা অডিশনেই পাস করি। তারপর থেকেই আমার চ্যানেল আইতে সংবাদ উপস্থাপক হিসেবে জীবন শুরু হয়। চ্যানেল আইতে আমি সংবাদ উপস্থাপক এবং সংবাদ প্রযোজক হিসেবে কাজ করতাম।


আনন্দভুবন : সংবাদ উপস্থাপক হওয়ার ইচ্ছেটা কি ছেলেবেলা থেকেই ছিল ?


ফারজানা করিম : ছেলেবেলা থেকে আসলে আমার কোনদিনই সংবাদ উপস্থাপক হওয়ার ইচ্ছে ছিল না। এটা হচ্ছে আমার বাবা-মায়ের ইচ্ছে। তখন তো আসলে বিটিভি ছাড়া অন্য কোনো চ্যানেল ছিল না। বিটিভিতে তখন তাহমিনা জাকারিয়া এবং আরো অনেক আপারা সংবাদ পড়তেন। তাদের সংবাদগুলো আব্বা দেখতেন এবং আমাকে দেখতে বলতেন। কিন্তু চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় সেটেল হয়ে আমি যেকোনো প্রাইভেট চ্যানেলে খবর পড়ব এটা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার ছিল ভাবনার দিক থেকে। এরকম ভাবনা কখনোই আমার ফ্যামিলির কেউ ভাবেনি। তাই ছেলেবেলা থেকে সংবাদ উপস্থাপনা নিয়ে আমার কোনো স্বপ্ন ছিল, এটা বলা যায় না।


আনন্দভুবন : পরিবার থেকে কি কোনো সহযোগিতা পেয়েছেন ? কার সহযোগিতা বেশি পেয়েছেন ?


ফারজানা করিম : পরিবার থেকে কোনো সহযোগিতা পাইনি। সে ক্ষেত্রে কার সহযোগিতা বেশি পেয়েছি সেটা বলার তো আর অবকাশ নেই। আমার জীবনে এ পর্যন্ত আসার জন্য যতগুলো কাজ করতে হয়েছে, সেটা শুধু সংবাদ উপস্থাপনার ক্ষেত্রে নয়, অন্য আরো অনেক কাজ তো আমি করি। কবিতা আবৃত্তি, পেইন্টিং, লেখালেখি করি। এসমস্ত কাজে আমি আমাকেই উৎসাহ দিয়েছি আমাকে কেউ কোনো সহযোগিতা করেনি।


আনন্দভুবন : প্রথম সংবাদপাঠের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাই-


ফারজানা করিম : প্রথম সংবাদ পাঠ বিটিভির চট্টগ্রাম কেন্দ্রে, সেই অভিজ্ঞতা খুবই সুন্দর। সবাই খুব আদর করে আমার ভয়টা দূর করে দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। প্রথম সংবাদপাঠ করতে মাকে সঙ্গে নিয়ে যাই। কারণ, ওটা ছিল সন্ধ্যাবেলার সংবাদ। তাই এত রাতে এত দূরে মা আমাকে একা যেতে দেবেন না। প্রথম সংবাদ পাঠ করে আমি যখন বের হই তখন আমাকে মা জড়িয়ে ধরেছিলেন এবং অনেক আদর করেছিলেন। আমাকে টিভির স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে, যেটা আমাদের কল্পনার বাইরে ছিল। এটা আমাদের জন্য অনেক বড়ো একটা ব্যাপার ছিল।


তো প্রথম সংবাদপাঠ এখানে একরকম আবার চ্যানেল আইতে অন্যরকম। চ্যানেল আই একটা প্রাইভেট চ্যানেল এবং চ্যানেল আইয়ের শুরু থেকেই আমি ছিলাম। সেখানে সংবাদ পাঠ নিয়ে ভয়ঙ্কর একটা তোড়জোড় পড়ে গিয়েছিল আমাদের পরিবারে।


আনন্দভুবন : সংবাদ উপস্থাপনা করতে গিয়ে কোনো বিব্রতকর অবস্থার সম্মুখীন হয়েছেন কী ?


ফারজানা করিম : সংবাদ উপস্থাপনা করতে গিয়ে অনেক বিব্রতকর অবস্থার সম্মুখীন হয়েছি। তার মধ্যে একটি বিব্রতকর অবস্থা হচ্ছে- সংবাদ উপস্থাপনা করার সময় একটি মশা ওড়াউড়ি করছিল আমার সামনে। সেই মশাটি একবার আমার নাকে এসে পড়ছে একবার আমার মুখে এসে পড়ছে। আমি কিছুতেই তাড়াতে পারছিলাম না, আমি লাইভে ছিলাম। একটা পর্যায়ে গিয়ে মশাটা আমার মুখের ভিতরে ঢুকে যায় আমিও সঙ্গে সঙ্গে ঢোক গিলে মশাটা খেয়ে ফেলি এবং নিউজ পড়া কন্টিনিউ করি। এরকম আরো অনেক বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছে।


আনন্দভুবন : সংবাদ উপস্থাপনার জন্য আলাদা কোনো প্রশিক্ষণ নিয়েছেন কি ?


ফারজানা করিম : সংবাদ উপস্থাপনার জন্য আলাদা প্রশিক্ষণ নেওয়ার মতো কোনো কর্মশালা আমাদের সময় ছিল না। সুতরাং আমি কোনো প্রশিক্ষণ নিইনি। আমি যা শিখেছি তা হচ্ছে আমাকে প্রথম দিনই হটসিটে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং আমি নিজে নিজেই কোপআপ করেছি। এটা অনেক কঠিন ছিল। কিন্তু এখন তো অনেক প্রশিক্ষণশালা আছে প্রশিক্ষণের জন্য। আমি নিজেও প্রশিক্ষণ দিই কয়েকটি জায়গায়। এখন ছেলেমেয়েদের হাতে অনেকগুলো অপশন আছে। আমাদের সময় কোনো অপশন ছিল না।


আনন্দভুবন : সংবাদ উপস্থাপনার পাশাপাশি অন্য কোনো পেশায় যুক্ত আছেন কি ?


ফারজানা করিম : সংবাদ উপস্থাপনার পাশাপাশি আমি মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ হিসেবে যুক্ত ছিলাম এনআইআইটিতে। তারপর চাকরিটা ছেড়ে দিই। কারণ, আমার আরো অনেক কাজ ছিল। আমি যেহেতু মঞ্চনাটক করি, আবৃত্তি করা হয়, আবৃত্তি খুব ভালোভাবে করা হয়। বিভিন্ন দেশে এবং আমাদের দেশের ভিতরে বিভিন্ন জেলায় গিয়ে আমি আমার নিজের লেখা কবিতা নিয়ে আবৃত্তিসন্ধ্যা করে থাকি। নিজের লেখা কবিতা আমি মানুষকে শোনাই এবং তারা মুগ্ধ হয়ে ভালোবেসে আমার কবিতা শোনেন। এটাকে আমি এস্টাবলিশ করার চেষ্টা করছি। পাশাপাশি   বিভিন্ন অর্গানাইজেশনে 

পার্টটাইম টিচার হিসেবে কাজ করছি


আনন্দভুবন : এই পেশায় ছেলেদের থেকে কি মেয়েদের প্রাধান্য বেশি দেওয়া হয়ে থাকে ?


ফারজানা করিম : ছেলে যদি স্মার্ট হয় এবং যদি তার গ্রহণ করার ক্ষমতা থাকে এবং কিছু দেওয়ার মতো ক্যাপাবিলিটি থাকে তাহলে একজন দুর্বল মেয়েকে কোনোদিন সংবাদ উপস্থাপক হিসেবে নেওয়া হবে না?। তো আমি এটাই বলবো, ছেলেদের থেকে মেয়েদের প্রাধান্য দেওয়া হয়ে থাকে এটা সম্পূর্ণ ভুল কথা। আমাদের দেশে তো এখন ছেলেমেয়ে একইভাবে নিউজ পড়ছে। এখানে কম-বেশি কিছু নেই। আসলে যে ভালো করবে, যে স্মার্টলি হ্যান্ডেল করতে পারবে তাকেই নিউজ প্রেজেন্টার হিসেবে যুক্ত করা হয়।


আনন্দভুবন : নতুনদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন-


ফারজানা করিম : আমি যেহেতু সংবাদ উপস্থাপনার ওপরে নতুনদের ক্লাস নিয়ে থাকি। তাই নতুনদের উদ্দেশ্যে আমি শুধু এটাই বলব যে, আপনি তখনই সংবাদ উপস্থাপনার জন্য যাবেন যখন আপনি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে বুঝতে পারবেন যে, আপনি পারবেন। তাছাড়া একটা প্রেজেন্টেবল ফেস থাকতে হবে সংবাদ উপস্থাপনার জন্য। এটা একটা উপস্থাপন তাই এগুলো আপনার আছে কিনা, আপনি নতুন এসে যে উচ্চারণ করছেন আদৌ সে উচ্চারণ দুই-তিন মাসের কোর্স করলে ঠিক হবে কি না এগুলোও আপনাকে মাথায় রাখতে হবে। সংবাদ শুধুমাত্র পাঠ নয়, সংবাদ অনেক কিছু। আপনার মধ্যে সেই কোয়ালিটি থাকতে হবে। সংবাদ পড়ার সময় আপনি যা বলছেন তার ওপরে আর কোনো সত্যি কথা নেই- এটাই সত্যি। এটা আপনাকে এস্টাবলিশ করে দিতে হবে। সুতরাং সে ক্ষেত্রে আপনার চেহারা, আপনার ফিগার, সবকিছু সেরকম যদি না হয় তাহলে আপনার কথাগুলো মানুষ গ্রহণ করবে না।


আনন্দভুবন : সংবাদ উপস্থাপনা নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী ?


ফারজানা করিম : সংবাদ উপস্থাপনা নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা আরকি, সংবাদ উপস্থাপনায় তো জড়িয়েই আছি। সংবাদে অনেক কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমে অনেক ধরনের পরিবর্তন প্রয়োজন। ভবিষ্যতে সেই পরিবর্তনগুলো আনার চেষ্টা চালানোর ইচ্ছা আছে।


আনন্দভুবন : আনন্দভুবনকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।


ফারজানা করিম : আনন্দভুবনকেও অনেক ধন্যবাদ, আমার কথাগুলো তুলে ধরার জন্য। আশা করছি আনন্দভুবন আরো সামনে এগিয়ে যাবে এবং অবশ্যই এমন কিছু মানুষকে সামনে নিয়ে আসবে যাদের দেখে আমরা অনুপ্রেরণা পাই। 


সাক্ষাৎকার : শহিদুল ইসলাম এমেল