ব্যাডমিন্টন খেলার নিয়মকানুন

25 Jan 2022, 03:31 PM ক্রীড়াভুবন শেয়ার:
ব্যাডমিন্টন খেলার নিয়মকানুন

ব্যাডমিন্টন একপ্রকার বহিরাঙ্গন ক্রীড়া। এটি একক বা যুগ্মভাবে খেলা হয়। ব্যাডমিন্টন খেলার জন্য নেট দ্বারা বিভক্ত একটি আয়তাকার কোর্ট প্রয়োজন হয়। খেলোয়াড় র‌্যাকেটের সাহায্যে তার প্রতিদ্বন্দীর কোর্টে শাটলকর্কটি ছুঁড়ে দিয়ে স্কোর সংগ্রহ করেন।

উনিশ শতকের মধ্যভাগে ভারতে নিযুক্ত ব্রিটিশ সেনা অফিসারেরা এই খেলা উদ্ভাবন করেন। তারা ইংল্যান্ডের ঐতিহ্যবাহী খেলা ব্যাটলডোর ও শাটলকর্কে একটি নেট যুক্ত করে এই খেলা চালু করেছিলেন। ব্রিটিশ গ্যারিসন নগরী পুনায় এই খেলা বিশেষ জনপ্রিয় ছিল বলে এই খেলার অপর নাম পুনাই। উনিশ শতকের শেষভাগে এই খেলা ইংল্যান্ডে ব্যাপক প্রচার পায়।

১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্ব ব্যাডমিন্টন নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ব্যাডমিন্টন ফেডারেশন [বর্তমান ব্যাডমিন্টন ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন] প্রতিষ্ঠিত হয়। আধুনিক বিশ্বে ইউরোপের বাইরে চীন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়াতেও ব্যাডমিন্টন বেশ জনপ্রিয়।

১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে পাঁচটি ইভেন্ট-সহ ব্যাডমিন্টন অলিম্পিকের অন্তর্ভুক্ত হয়। এই ইভেন্টগুলো হলো : পুরুষ ও মহিলাদের সিঙ্গলস, পুরুষ ও মহিলাদের ডাবলস এবং মিক্সড ডাবলস।


ব্যাডমিন্টন খেলা আবিষ্কারের ইতিহাস

আজ থেকে প্রায় সোয়াশো বছর আগে এই খেলার সূত্রপাত ঘটে। ইংল্যান্ডের গ্লুচেস্টারশায়ার রাজ্যেও ব্যাডমিন্টন নামক গ্রামের ব্যাটেরডোর হলে ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দে এক বৃষ্টি ভেজা দিনে এ খেলা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর থেকে এখানে নিয়মিত খেলা হতো এবং উৎসুক দর্শকরা আগ্রহ সহকারে এই খেলা উপভোগ করত। এভাবে ধীরে ধীরে খেলাটি বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ডে ‘ব্যাডমিন্টন অ্যাসোশিয়েশন’ গঠন করা হয়। জনপ্রিয়তা অব্যাহত থাকায় ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ডের একটি পুরুষ ALL England Championship অনুষ্ঠিত হয়।

ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্ট

এরই ধারাবাহিকতার সিঁড়ি বেয়ে ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে International Badminton Federation [I.B.F] গঠিত হয়। প্রথম সভাপতি হন স্যার ভাই থমাস। তিনি ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্টের জন্য একটি রুপার কাপ দেন। তার নামানুসারে আজও ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্ট ‘থমাস কাপ’ নামেই প্রচলিত।

মেয়েদের জন্য টুর্নামেন্টের ব্যবস্থা সর্বপ্রথম করা হয় ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে। মিসেস এইচ. এস. উবের মেয়েদের জন্য একটি কাপ দেন। বর্তমানে মহিলাদের টুর্নামেন্টের কাপটি ‘উবের কাপ’ নামেই পরিচিত। এর দু’বছর পরে ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে এশিয়ার কয়েকটি প্রতিনিধি দল মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে এক বৈঠকের মাধ্যমে সর্বসম্মতিক্রমে Badminton Federation [I.B.F] গঠিত হয়।


ব্যাডমিন্টন খেলার আইনকানুন

১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে International Badminton Federation [I.B.F] গঠিত হওয়ার পর ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে সর্বপ্রথম খেলাটির নিয়মকানুন প্রণীত হয়। তারপর বিভিন্ন সময়ে তা পরিবর্তিত, সংশোধিত ও সংযোজিত হয়ে ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে পূর্ণতা লাভ করে। ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রণীত নীতিমালা এখনো কার্যকর রয়েছে। ব্যাডমিন্টন খেলার কিছু নিয়মকানুন আছে :


কোর্ট [Court]

১. ব্যাডমিন্টন খেলার কোর্টটি হবে আয়তক্ষেত্র এবং সীমানা নির্ধারণ করতে হবে ৪০ মি.মি প্রস্থ করে

২. কোর্টটি সাদা অথবা হলুদ লাইন দিয়ে রেখা বা দাগ কাটতে হবে যাতে সহজে পৃথক করা যায়

৩. সঠিকভাবে অঞ্চল রেখা অংকন করতে হবে [আইন ৪.৪]। অতিরিক্ত চারটি রেখা ৪০ মি.মি। ৪০ মি.মি ভেতরের দিকে এককভাবে খেলার জন্য কোর্ট হবে। আর পেছন থেকে সীমানা রেখা হবে ৫৩০ মি.মি এবং ৯৯০ মি.মি

৪. প্রতি সীমানার রেখা আয়তনের অংশ হবে যেখান থেকে সীমানা নিরূপণ করা হয়েছে

৫. যদি দ্বৈত খেলার স্থান উপযুক্ত না হয় তাহলে ‘নকশা বি’ অনুযায়ী একক খেলার কোর্ট করতে হবে।


র‌্যাকেট [Racket]

১. র‌্যাকেটের উপরিভাগ অর্থাৎ আঘাত হানার জায়গাটি হবে সমতল। যা আড়াআড়িভাবে দড়িজাতীয় তার দিয়ে ঘনিষ্ঠভাবে পেঁচানো থাকবে। দড়িটি হবে সাধারণ ধরনের কিংবা বিশেষ। যা হোক তার কেন্দ্রের চারদিকে কাছাকাছি করে পেঁচানো থাকবে

২. র‌্যাকেটের ফ্রেম হাতলসহ লম্বায় ৬৮০ মিলিমিটারের বেশি হবে না এবং সামনের গভীরতা ২৩০ মি. মিটারের বেশি হবে না

৩. র‌্যাকেটের সামনের মাথা লম্বায় হবে সর্বসমেত ২৯০ মি. মিটারের মধ্যে

৪. তবে ক্ষেত্রবিশেষ উপরিভাগটি ২৮০ মিলিমিটারের বেশি লম্বা এবং ২২০ মিটারের বেশি গভীর হতে পারবে না

৫. র‌্যাকেট

৬. র‌্যাকেটটি বহিঃপ্রসারণ থেকে মুক্ত থাকবে যাতে কোন কিছু আটকে না যায় এবং সঠিকভাবে ব্যবহার করা যায়। র‌্যাকেটের হাতল এবং বুনন ও ওজন সঠিক থাকবে।

৭. তবে র‌্যাকেট যেকোনো ধরনের কৌশলের বাইরে থাকতে হবে যাতে খেলোয়াড়েরা র‌্যাকেটের আকার পরিবর্তন করে খেলতে পারে।

খেলোয়াড় [Players]

১. ম্যাচে যারা অংশগ্রহণ করবে তারাই হবে খেলোয়াড়।

২. যদি এক পক্ষে দুজন করে খেলে তাহলে সেটা হবে দ্বৈত খেলা বা ডাবলস্ আর যদি এক পক্ষে একজন করে থাকে তাহলে সেটা হবে একক বা সিঙ্গেলস খেলা।

৩. যারা সার্ভিস করবে তাদের পক্ষকে বলা হবে ’ইন’ সাইড আর তার বিপক্ষ দলকে বলা হবে ’আউট’ সাইড।


টস [Toss]

খেলা শুরুর পূর্বে দু’পক্ষের মধ্যে টস হবে। যারা টসে জিতবে তারা কিছু সুবিধা পাবে :

১. প্রথম সার্ভিস করবে

২. সাইড নিরূপণ বা পছন্দ করবে


পয়েন্ট [Scoring]

১. পুরুষদের একক বা দ্বৈত খেলায় ১৫ পয়েন্টে গেম সফল হবে যদি পয়েন্ট ১৩ সমান সমান হয়

২. এ ক্ষেত্রে যে দল প্রথমে ১৩ করবে তাদের ৫ পর্যন্ত সেটিং করার অধিকার থাকবে

৩. ১৪ সমান পয়েন্ট হলে ৩ পর্যন্ত সেটিং করার অধিকার থাকবে। কিংবা খেলোয়াড়েরা ইচ্ছা করলে ১৫ পয়েন্টেই ডিউস না নিয়ে শেষ করতে পারবে

৪ গেম শেষ হয়ে যাবার পর পয়েন্ট দাঁড়াবে লাভ অল [Love All] এবং যে দল সমান সমান ১৩ বা সমান সমান ১৪ পয়েন্টের সেট অনুযায়ী ৫ বা ৩ পয়েন্ট সংগ্রহ করবে সে দল বিজয়ী হবে

৫. গেম সেট করার অধিকারের জন্য ১৮ সমান যা ১৪ সমান পয়েন্ট-এ যাওয়ার পরের সার্ভিস করার পূর্বেই সমান করতে হবে

৬. মেয়েদের সিঙ্গেলস্ খেলা ১১ পয়েন্টে হবে। যদি ৯ সমান পয়েন্ট হয় তবে যে প্রথম ৯ পয়েন্ট করবে তার ৩ পয়েন্ট সেট করার এবং পয়েন্ট ১০ সমান হলে যে প্রথম ১০ করবে তার ২ পর্যন্ত সেটিং করার অধিকার থাকবে

৭. এ ক্ষেত্রে ইচ্ছা করলে খেলোয়াড়েরা ১১ পয়েন্টেই ডিউস্ না নিয়ে শেষ করতে পারবে

৮. যে পাশ বা দল প্রথম সুযোগে সেটিং করার অধিকার প্রত্যাখান করবে তাকে দ্বিতীয় সেটিং করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না

৯. উল্লিখিত ‘এ’ প্যারাগ্রাফ সত্তে¡ও, পূর্ব ব্যবস্থা থাকলে কেবল একটা গেম খেলা যেতে পারে এবং সেটা হবে ২১ পয়েন্টে, সে ক্ষেত্রে সেটিং হবে ১৫ পয়েন্টের খেলার মতো ১৯ এবং ২০-এ বিকল্প নম্বর হবে যথাক্রমে ১৩ এবং ১৪ পয়েন্টের মতো।


সার্ভিস [Service]

সঠিক সার্ভিস হলো-

১. ডান হাতের সার্ভিস কোর্ট থেকে প্রতিবারের প্রথম সার্ভিস করতে হবে

২. সার্ভিসকারীর র‌্যাকেটের দ্বারা শাটল আঘাতপ্রাপ্ত হলেই সার্ভিস হয়েছে বলে ধরা হবে। শাটল তারপর ‘ইন’ থাকবে

৩. সার্ভিস হওয়ার পরে সার্ভিসকারী তার পক্ষের খেলোয়াড় নিজেদের দিকে যেকোনো স্থানে দাঁড়াতে পারবে বা যেতে পারবে

৪. তবে যার কাছে সার্ভিস করা হবে প্রথমে কেবল সেই সার্ভিসটি গ্রহণ করবে, কিন্তু তার অন্যসঙ্গী সার্ভিস রিসিভ করলে বিপক্ষ খেলোয়াড় পয়েন্ট পেয়ে যাবে

৫. কেবল একজন খেলোয়াড় [যে খেলার শুরুতে সার্ভিস শুরু করবে] প্রথম ইনিংসে সার্ভিস করতে পারবে। তারপরের সুযোগ পরবর্তী থেকে দুজন খেলোয়াড়ই সার্ভিস করার অধিকার পাবে

৬. খেলায় জয়লাভকারী দল পরবর্তী গেমের প্রথমেই সার্ভিস করবে

৭. এ ক্ষেত্রে বিজয়ী যেকোনো খেলোয়াড় সার্ভিস করবে এবং পরাজিত যেকোনো একজন সার্ভিস গ্রহণ করবে

৮. যদি একজন সার্ভিসকারী তার সময় ছাড়া সার্ভিস করে বা ভুল সার্ভিস কোর্ট ব্যবহার করে তবে এ ক্ষেত্রে এটা একটা লেট বলে ধরা হবে যা পরবর্তী সার্ভিস চাওয়া বা দেওয়া যাবে। অথবা আম্পায়ার এ ব্যাপারে আদেশ করতে পারেন

৯. আউট সাইড বা গ্রহণকারী পক্ষের একজন খেলোয়াড় যদি ভুল সার্ভিস কোর্টে সার্ভিস গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুতি সহ্য করে এবং সার্ভিসের পর তারা র‌্যালি বিজয়ী হয় তাহলে সেটাও লেট বলে ধরা হবে বা চাওয়া যাবে। তবে, পরবর্তী সার্ভিস শুরু করার পূর্বে তা আম্পায়ার দ্বারা ঘোষিত হতে হবে

১০. উপরে বর্ণিত যেকোনো বিজয়ে দোষী পক্ষ যদি র‌্যালি হারায় তাহলে ভুল থেকে যাবে এবং খেলোয়াড়দের অবস্থান ঠিক করা যাবে না।

১১. অসাবধনতাবশত যদি কোনো খোলোয়াড় কোর্ট পরিবর্তন করে যখন সেটা তার করা উচিত নয় এবং পরবর্তী সার্ভিস না হওয়া পযর্ন্ত যদি এই ভুল ধরা না পড়ে, তাহলে এই ভুলটি থাকবে এবং লেট দাবি করা বা দেয়া যাবে না এবং খেলোয়াড়দের অবস্থানও সংশোধন করা যাবে না।


সিঙ্গেলস্ [Singles]

সিঙ্গেলস্ খেলায় অন্যান্য আইন ঠিকই থাকবে, তবে ব্যতিক্রম হবেÑ

১. সার্ভিসকারীর পয়েন্ট শূন্য হলে বা খেলার জোড় পয়েন্ট হলে খেলোয়াড় বা গ্রহণকারী তাদের ডানহাতের সার্ভিস কোর্ট থেকে সার্ভিস গ্রহণ করবে

২. যখন সার্ভিসকারীর পয়েন্ট ব্যতিক্রমী বা বিজোড় হয় তখন সার্ভিস প্রেরণ ও গ্রহণ তাদের বামহাতের সার্ভিস কোট থেকে হবে

৩. প্রতিটি পয়েন্টের পর উভয় দিকের খোলোয়ার সার্ভিস কোর্ট বদল করবে


ডাবলস্ [Dubbles]

১. কোন পক্ষ প্রথম সার্ভিস করবে সেটা সিদ্ধান্ত হবে। খেলোয়ড় ডানহাতের সার্ভিস কোর্ট থেকে তার ঠিক কোনাকুনি খেলোয়াড়কে সার্ভিস করবে। যদি তার বিপক্ষ খেলোয়াড় শাটল মাটিতে স্পর্শ করার আগ মুহূর্র্তে ফেরত পাঠায় এবং ইনসাইডের দ্বারা যদি ফেরত পাঠানো হয় কিংবা আউট সাইডের দ্বারা যদি ফেরত পাঠেনো হয় এবং এভাবে চলতে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো অপরাধ বা ভুল না হয় কিংবা শাটল ইন প্লে হয়ে যায়।

২. যদি ইনসাইডের দ্বারা ভুল সংঘটিত হয় তাহলে তার সার্ভিস করার অধিকার  ক্ষুন্ন হবে। এইভাবে বিপক্ষের ডানদিকের কোর্টে দাঁড়ানো খেলোয়াড় সার্ভিস পেয়ে যাবে। কিন্তু সার্ভিস ফেরত না এলে বা কোনো আউট সাইড অপরাধ করলে ইনসাইড পয়েন্ট পেয়ে যাবে। ইনসাইডের খেলোয়াড়েরা তখন এক সার্ভিস কোর্ট থেকে অন্য কোর্টে বদল হবে।

বাম হাতের সার্র্ভিস কোর্ট থেকে বিপরীতমুখী কোর্ট সার্ভিস হবে। যতক্ষণ একপক্ষ ইনে থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত প্রতিটি কোট থেকে কোনাকুনি বিপরীতমুখী কোর্টে সার্ভিস করতে হবে এবং এভাবে ইন সাইড কর্তৃক সার্ভিস কোর্ট বদল হবে। তখন একটি পয়েন্ট তার স্কোরে যোগ হবে। 

গ্রন্থনা : শহিদুল ইসলাম এমেল