একক পেশা হিসেবে সংবাদ উপস্থাপনা একটু চ্যালেঞ্জিং -ফারহানা তৃনা

01 Mar 2022, 01:12 PM সংবাদ উপস্থাপক শেয়ার:
একক পেশা হিসেবে সংবাদ উপস্থাপনা একটু চ্যালেঞ্জিং -ফারহানা তৃনা

টিভি সংবাদ উপস্থাপনার ক্ষেত্রে স্পষ্ট উচ্চারণ, সুন্দর বাচনভঙ্গি ও আকর্ষণীয় চেহারা এবং দর্শকপ্রিয়তা বা জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে হাতেগোনা যেক’জন সংবাদ উপস্থাপক এগিয়ে আছেন বাংলাভিশন চ্যানেলের ফারহানা তৃনা তাদের মধ্যে অন্যতম। দর্শকনন্দিত এই সংবাদ উপস্থাপকের বিস্তারিত আনন্দভুবনের পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো...


আনন্দভুবন : কেমন আছেন ?

ফারহানা তৃনা : আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি ।

আনন্দভুবন : শুরুতেই জানতে চাই সংবাদ উপস্থাপক হয়ে ওঠার গল্পটা কী ছিল ? 

ফারহানা তৃনা : ছেলেবেলা থেকেই আমি বেড়ে উঠেছি সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে। আমার মায়ের আগ্রহের জন্যেই পড়াশোনার পাশাপাশি আমাদের ভাইবোনদের শিক্ষক রেখে আলাদা করে গান, কবিতা শেখানো হয়েছে। পরবর্তীসময়ে মায়ের ইচ্ছাতেই বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে নাচ শেখার জন্য ভর্তি হই এবং সেখান থেকে সার্টিফিকেট কোর্সও সম্পন্ন করি। তারপর ২০০৮ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে শিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্তির মধ্য দিয়ে আমার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে পথচলা শুরু এবং পরে ধীরে ধীরে অনুষ্ঠান উপস্থাপনায় আসা। বাংলাদেশ টেলিভিশনে আমি অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেছি। নাচের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছি এটিএন বাংলা, এনটিভি’র হয়ে। ছেলেবেলা থেকেই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কাজ করায় ক্যামেরাভীতি আমার কখনোই ছিল না। নাচ থেকে অভিনয় বা অন্যান্য শিল্প-মাধ্যমে কাজ করার সুযোগ থাকলেও সেগুলো আমাকে কখনো টানেনি যতটা উপস্থাপনায় টেনেছে। সংবাদ উপস্থাপনা একটি সম্মানজনক পেশা তাই বরাবরই সেটার প্রতি আকর্ষণ ছিল আমার। আর নাচ-গান, কবিতা চর্চা এগুলো কিন্তু আমাকে সংবাদ উপস্থাপক হতে খানিকটা সহায়তা করেছে। তারপরও নিজেকে তৈরি করতে ট্রেনিং নিয়েছি, বিভিন্ন চ্যানেলে সিভি ড্রপ করেছি। অডিশনের কল এসেছে, দিয়েছি। সহসাই হয়ে গেছে সেটা নয়, কিন্তু হাল ছাড়িনি, ধৈর্য নিয়ে চেষ্টা করে গেছি, এভাবেই একসময় সংবাদ উপস্থাপনার সুযোগ পেয়েছি। এশিয়ান টিভি, ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভি হয়ে বর্তমানে বাংলাভিশনে আছি। একইসাথে ইংরেজি সংবাদ উপস্থাপক ও অনুষ্ঠান উপস্থাপক হিসেবে বাংলাদেশ বেতারেও কাজ করছি।

আনন্দভুবন : সংবাদ উপস্থাপক হওয়ার ইচ্ছেটা কি ছেলেবেলা থেকেই ছিল ?

ফারহানা তৃনা : একদম ছেলেবেলা থেকে ছিল তা নয়, একটু বড়ো হয়েই ইচ্ছেটা হয়েছে। সংবাদ উপস্থাপনা একটি সম্মানজনক পেশা তাই পরিবার থেকেও আমার এই আগ্রহের কথা জানতে পেরে আমাকে সবাই যথেষ্ট উৎসাহ দিয়েছিল।

আনন্দভুবন : পরিবার থেকে কি কোনো সহযোগিতা পেয়েছেন ? কার সহযোগিতা বেশি পেয়েছেন ?

ফারহানা তৃনা : অবশ্যই পেয়েছি, আমার মা সবসময়ই আমার অনুপ্রেরণার বড়ো উৎস। তিনি সবসময় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমার সঙ্গেই থাকতেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনেও মা সঙ্গে করেই অডিশনে নিয়ে গেছেন। আর এরপর যদি বলতে হয় আমার হাজবেন্ডের কথা বলতে হবে, যার কাছ থেকে প্রতিনিয়ত এখনো সহযোগিতা পেয়ে চলেছি। সে আমার সংবাদ উপস্থাপনার একজন বড়ো দর্শক এবং তার গঠনমূলক সমালোচনা আমার সংবাদকর্মী ও আবৃত্তিকার হিসেবে পথচলায় অনেক বড়ো ভূমিকা রেখেছে। তাছাড়া সংবাদ উপস্থাপনায় সময় অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সময়মতো অফিসে থাকতে হয়। লেট করার কোনো সুযোগ আমাদের নেই, তাই পরিবার থেকে শতভাগ সহযোগিতা না পেলে সময়ের সঙ্গে দৌড়ানো বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে আমি আমার শাশুড়ির কাছ থেকেও অনেক সময় সাপোর্ট পেয়েছি। তিনি যখন বেঁচে ছিলেন তখন অনেক সময় আমার অফিসে রাতে নিউজ থাকলে আমাকে রান্না নিয়ে ভাবতে হতো না। এগুলো আসলে ভালোবাসারই বহিঃপ্রকাশ। এই সহযোগিতাগুলো পেয়েছি বলেই কাজ করা অনেকটাই সহজ হয়েছে।

আনন্দভুবন : প্রথম সংবাদ পাঠের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাই-

ফারহানা তৃনা : ছেলেবেলা থেকেই আবৃত্তি, গান, নাচ- এগুলো ঘিরে আমাকে মঞ্চে উঠতে হয়েছে। তাছাড়া বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপস্থাপনা ও কাজের সূত্রে ক্যামেরাভীতিটা আমার কেটে গিয়েছিল। তবে, সংবাদ উপস্থাপনার প্রথম দিনটা ছিল একটু ব্যতিক্রম অনুভূতির দিন। এতদিনের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের দিন। আমার দিক থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা ছিল ভালো করার। প্রথম সংবাদ পাঠ শেষে আমার পুরো নিউজ টিম এবং অফিসের সবাই বেশ প্রশংসা করেছে এতটুকুই মনে আছে। আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব যারা দেখেছে তাদের কাছে কখনোই মনে হয়নি যে, ওটা আমার সংবাদ পাঠের প্রথম দিন ছিল। এই প্রশংসাবাক্যগুলোই পরবর্তীসময়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।

আনন্দভুবন : একজন ভালো সংবাদ উপস্থাপক হওয়ার জন্য কী কী গুণ থাকা দরকার বলে আপনি মনে করেন। কোন জিনিসগুলো জানা প্রয়োজন ?

ফারহানা তৃনা : সবসময় আপ-টু-ডেট থাকতে হবে। উচ্চারণের শুদ্ধতা থাকা বাঞ্ছনীয়, সময়ানুবর্তিতা, আত্মবিশ্বাস, দায়িত্ববোধ, নিষ্ঠা এবং সর্বোপরি ধৈর্য্য। সংবাদ উপস্থাপনায় যেকোনো পরিস্থিতিতে সাবলীল থাকাটা অনেক জরুরি । আর ট্রেনিং করলে স্টুডিও ও ক্যামেরাভীতি অথবা জড়তা অনেকটাই কেটে যায়।

আনন্দভুবন : সংবাদ উপস্থাপনা করতে গিয়ে কোনো বিব্রতকর অবস্থার সম্মুখীন হয়েছেন কি ?

ফারহানা তৃনা : একটা ঘটনা মনে পড়ছে, একবার লাইভে থাকা অবস্থায় আমার ঠিক কাছের একটা ক্যামেরা স্ট্যান্ডসহ হঠাৎ করে পড়ে যায় ঠিক আমার পাশে, একটুর জন্য আমার মাথার ওপর পড়েনি। কিন্তু ওই মুহূর্তে যেহেতু লাইভ চলছিল তাই আমাকে খুবই স্বাভাবিক থেকে লাইভ চালিয়ে নিতে হয়েছে। যদিও ক্যামেরা পড়ে যাওয়ার প্রচণ্ড শব্দ সবাই পেয়েছিল। পরবর্তীসময়ে অবশ্য সংবাদ শেষে সেদিন যারা প্রডিউসার ছিলেন সবাই বেশ প্রশংসা করেছেন এত স্বাভাবিকভাবে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। তাছাড়া আমাদের সামনে যে অটো স্ক্রিপ্ট থাকে সেটা যান্ত্রিক গোলযোগের কারণেও হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যেতে পারে, সেই মুহূর্তে পরিস্থিতি অনেক সময়ই সামলে নিতে হয় ।

আনন্দভুবন : সংবাদ উপস্থাপনার জন্য আলাদা কোনো প্রশিক্ষণ নিয়েছেন কি ?

ফারহানা তৃনা : আবৃত্তিচর্চা আমাকে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে অনেকখানি এগিয়ে দিয়েছে। ২০০৬ সাল থেকে আবৃত্তি সংগঠন কণ্ঠশীলনে আমার আবৃত্তি চর্চার সূচনা, এখন আবৃত্তি সংগঠন স্বরচিত্রের সঙ্গে আবৃত্তিচর্চায় সম্পৃক্ত আছি। তারপরও প্রশিক্ষণ নিয়েছি, যেহেতু সংবাদ উপস্থাপনার ব্যাপারে আমার দৃঢ় সংকল্প ছিল। তাই শুধু প্রশিক্ষণ নয় আমি নিজেকে চর্চার মধ্যে রাখতে পত্রিকা পড়া, নিয়মিতভাবে সংবাদ দেখা এসব আমার প্রাত্যহিক কাজের অংশ করে নিয়েছি।

আনন্দভুবন : সংবাদ উপস্থাপনার পাশাপাশি অন্য কোনো পেশায় যুক্ত আছেন কি ?

ফারহানা তৃনা : আমি দীর্ঘ পাঁচ বছর একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এনালাইসিস্ট হিসেবে কাজ করেছি এবং এর পাশাপাশি অবসরে সংবাদ উপস্থাপনা চালিয়ে গিয়েছি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সংবাদ উপস্থাপনা আমার শখ থেকে পেশায় পরিণত হয়েছে। তাই বর্তমানে সংবাদ উপস্থাপনা পুরোপুরিভাবে করছি আর এর পাশাপাশি আবৃত্তি নিয়ে বেশ কিছু কাজ করেছি ও করছি। আমার ইতোমধ্যে দুটো আবৃত্তির অ্যালবামের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। আশা করছি এবছরই অ্যালবাম দু’টি প্রকাশ পাবে। এছাড়া, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া আয়োজিত সংবাদ উপস্থাপনায় প্রশিক্ষণ কোর্সে একজন প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করছি।

আনন্দভুবন : এই পেশায় ছেলেদের থেকে কি মেয়েদের প্রাধান্য বেশি দেওয়া হয়ে থাকে ?

ফারহানা তৃনা : সবসময় নয়, বিভিন্ন চ্যানেলের বিভিন্ন রকম পলিসি থাকে। সেক্ষেত্রে কখনো কখনো মেয়েরা প্রাধান্য পায় কিছু কিছু চ্যানেলে। তবে আজকাল অধিকাংশ চ্যানেলেই ছেলে এবং মেয়ে একসঙ্গে কাজ করে চলেছে, নিজেদের যোগ্যতা ও দক্ষতার সাথে। তবে এটা ঠিক, সম্পূর্ণ একক পেশা হিসেবে নেওয়ার জন্য সংবাদ উপস্থাপনা একটু চ্যালেঞ্জিং। সেদিক থেকে হয়তো ছেলেদের সংখ্যা কিছুটা কম।

আনন্দভুবন : সংবাদ উপস্থাপনা নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী ?

ফারহানা তৃনা : সংবাদের সঙ্গে আছি এবং সংবাদের সঙ্গেই থাকব। এখন পর্দার সামনে কাজ করছি, একটা সময়ের পর পর্দার আড়ালেও কাজ করার ইচ্ছা আছে যদি সে সুযোগ হয়।

আনন্দভুবন : অবসরে কী করেন এবং কোথায় বেড়াতে যেতে পছন্দ করেন ?

ফারহানা তৃনা : অবসর খুব একটা পাই না। যতটুকু পাই সংবাদ উপস্থাপনার পাশাপাশি কবিতার সংগঠন, আবৃত্তিচর্চা এসব নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটে। তার বাইরে যেটুকু সময় পাই, পরিবারের সঙ্গেই কাটাই এবং সুযোগ পেলেই পরিবার নিয়ে দেশে এবং দেশের বাইরে ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ি। তবে সমুদ্র আমাকে খুব টানে- এমনো হয়েছে কোনোরকম পূর্বপরিকল্পনা ছাড়াই হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত নিয়ে এক-দু’দিনের ছুটিতেও কক্সবাজার ছুটে গিয়েছি।

আনন্দভুবন : আনন্দভুবনকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

ফারহানা তৃনা : আপনাকেও ধন্যবাদ এবং একইসঙ্গে আনন্দভুবন ও আনন্দভুবনের পাঠকদেরও ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা। 

সাক্ষাৎকার : শহিদুল ইসলাম এমেল