ভুল করতে করতে শিখেছি -জাকিয়া জাবের

23 Mar 2022, 01:03 PM সংবাদ উপস্থাপক শেয়ার:
ভুল করতে করতে শিখেছি -জাকিয়া জাবের

টিভি সংবাদ উপস্থাপনার ক্ষেত্রে স্পষ্ট উচ্চারণ, সুন্দর বাচনভঙ্গি ও আকর্ষণীয় চেহারা এবং দর্শকপ্রিয়তা বা জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে হাতে গোণা যে ক’জন সংবাদ উপস্থাপক এগিয়ে আছেন এটিএন নিউজ-এর জাকিয়া জাবের তাদের মধ্যে অন্যতম। দর্শকনন্দিত এই সংবাদ উপস্থাপকের বিস্তারিত আনন্দভুবনের পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো...

আনন্দভুবন : কেমন আছেন ?

জাকিয়া জাবের : আলহামদুলিল্লাহ ভালো।

আনন্দভুবন : শুরুতেই জানতে চাই সংবাদ উপস্থাপক হয়ে ওঠার গল্পটা কী ছিল ?

জাকিয়া জাবের : সেইভাবে কোনো গল্প আসলে নেই। আসলে সংবাদ উপস্থাপক হবার ইচ্ছা বা স্বপ্ন বা পরিকল্পনা কখনোই ছিল না। এইচএসসির পরে অ্যাডমিশন টেস্টের পরবর্তীসময়ে বিভিন্ন কারণেই আমি বেশ হতাশায় ভুগছিলাম। তখন আমার মা আমাকে খুব বলতেন কোনো কোর্সে জয়েন করতে। যেকোনো কোর্সই হোক না কেন, যাতে অন্তত মনোযোগটা ঐদিকে থাকে। তখন একটু খোঁজ নিয়ে দেখলাম, একটি প্রতিষ্ঠানে সংবাদ উপস্থাপনার একটা কোর্স শুরু হতে যাচ্ছে কয়েক দিনের মধ্যেই। তারপর কোনো চিন্তা ভাবনা না করেই ভর্তি হয়ে গেলাম সেখানে। ক্লাস শুরু হয়ে গেল এবং ক্লাসগুলো খুবই ইন্টারেস্টিং লাগত আমার কাছে, সেইসঙ্গে নতুন বেশ কিছু বন্ধুও জুটে গেল। ক্লাসের মজা, আর নতুন বন্ধুদের জন্যই নিয়মিত ক্লাস করতাম। সত্যি বলতে তখনো সংবাদ উপস্থাপনা নিয়ে আমি আসলে সিরিয়াস ছিলাম না বা সংবাদ উপস্থাপক হবো কখনো এটা নিজের মনে বিশ্বাস করে উঠিনি। তো ঐখানে যেসব ট্রেইনাররা আসতেন ক্লাস নিতে, তারা খুব প্রশংসা করতেন আমার, আর খুবই উৎসাহ দিতেন। বিশেষ করে বাংলাদেশের সংবাদ উপস্থাপনার লিজেন্ড বলা যায় যাকে, শ্রদ্ধেয় শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম একদিন এসেছিলেন আমাদের ক্লাস নিতে। উনি বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবার ভুলগুলো ধরিয়ে দিচ্ছিলেন। সেদিন শুধুমাত্র আমার বেলাতেই উনি ভুল কম ধরে প্রশংসা বেশি করলেন। সেদিনের পর থেকেই মনে হলো হয়ত আমি পারব সংবাদ উপস্থাপনায় আসতে, আমাকে দিয়ে বোধহয় সম্ভব। এই বিশ্বাসটা আমার মধ্যে জন্মানোর পরই বিষয়টাকে সিরিয়াসলি নিলাম। একদম মন দিয়ে লেগে পড়লাম সংবাদ উপস্থাপক হওয়ার জন্যে। তারপর থেকেই অনেক অনেক প্র্যাকটিস করেছি, নিজেকে প্রতিনিয়তই আরও উন্নত করেছি, ভুল করেছি, ভুল করতে করতে শিখেছি। আমি প্রথম সিভি জমা দিয়েছিলাম এটিএন নিউজে, প্রথম অডিশনও দিয়েছি এখানেই, ধাপে ধাপে বেশ কিছু অডিশন-পর্ব পার করে তারপরই প্রথম অনএয়ারের সুযোগ পাই এবং সত্যি সত্যিই সংবাদ উপস্থাপক বনে যাই।

আনন্দভুবন : সংবাদ উপস্থাপক হওয়ার ইচ্ছেটা কি ছেলেবেলা থেকেই ছিল ?

জাকিয়া জাবের : না, ওই যে বললাম, ইচ্ছা কখনোই ছিল না। পড়াশোনা নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকতাম তখন। তবে ছেলেবেলায় স্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপস্থাপনা করেছি, স্পিচ দিয়েছি। আমি ভিকারুননিসা নূন স্কুলে পড়তাম। স্কুলে আপারা বই থেকে রিডিং পড়তে দিতেন আমাকে, আমি একটা অংশ রিডিং পড়ে দিতাম, আপা ওই অংশটা ক্লাসকে বুঝিয়ে দিতেন। রিডিং পড়াটা বোধহয় সুন্দর ছিল ছেলেবেলা থেকেই। উচ্চারণও বরাবরই শুদ্ধ ছিল আমার। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও উপস্থাপনা করেছি, স্পিচ দিয়েছি, নিজেদের বানানো বিভিন্ন ছোটোখাটো ভিডিওর ব্যাকগ্রাউন্ডে ভয়েস দিয়েছি, এই তো। তবে সংবাদ উপস্থাপক হবো কোনোদিন, এরকমটা কখনোই ভাবিনি।

আনন্দভুবন : পরিবার থেকে কি কোনো সহযোগিতা পেয়েছেন ? কার সহযোগিতা বেশি পেয়েছেন ?

জাকিয়া জাবের : সংবাদ উপস্থাপনায় আসার ক্ষেত্রে অবশ্যই পরিবারের সহযোগিতা এবং উৎসাহ ছিল। বিশেষ করে আমার মায়ের অসম্ভব সহযোগিতা ছিল আমার সংবাদ উপস্থাপক হয়ে ওঠার পেছনে। তবে সংবাদ উপস্থাপক হিসেবে টিকে থাকার পেছনে আমার ছোটোভাই এবং আমার বন্ধুদের মানসিক সহযোগিতার কথা অবশ্যই বলতেই হবে। এরা আমার সবচেয়ে বড়ো সাপোর্টার।

আনন্দভুবন : প্রথম সংবাদ পাঠের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাই-

জাকিয়া জাবের : প্রথম সংবাদ পাঠ বা এটিএন নিউজে আমার প্রথম অনএয়ারের গল্প একদিক থেকে বেশ মজার। কারণ, আমার প্রথম অনএয়ার হয়েছিল ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে আমার জন্মদিনের দিন। ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকে ঐদিনটা তাই এই দুটো কারণে খুব স্পেশাল আমার কাছে। ঐ নিউজটা অনেক রাতে ছিল, রাত ২টার সংবাদ ছিল এবং রোজার মাস ছিল। তবুও আমার পুরো পরিবার এবং আমার সব বন্ধুরা এত রাত পর্যন্ত জেগে ছিল শুধুমাত্র আমার প্রথম সংবাদ উপস্থাপনা তারা দেখবে বলে। আমি নিজেও কিছুটা ভয়ে ছিলাম, তবে সুন্দর এবং ঠিকঠাকভাবেই নিউজ শেষ করেছিলাম। অফিসের সবাইও বেশ প্রশংসা করেছিলেন। সেইবার জন্মদিনের শুভেচ্ছা যেমন পেয়েছিলাম, সমানভাবে সংবাদ উপস্থাপনার জন্য অনেক অনেক মানুষের অনেক শুভকামনাও পেয়েছিলাম।

আনন্দভুবন : একজন ভালো সংবাদ উপস্থাপক হওয়ার জন্য কী কী গুণ থাকা দরকার বলে আপনি মনে করেন, কোন জিনিসগুলো জানা প্রয়োজন ?

জাকিয়া জাবের : আমার সংবাদ উপস্থাপনার ক্যারিয়ার খুবই ছোটো, তবে আমার যেটা মনে হয়, সবার প্রথমে জরুরি হচ্ছে শুদ্ধ উচ্চারণ জানা এবং বাচনভঙ্গি সুন্দর হওয়া। এছাড়াও সংবাদ উপস্থাপকদের অবশ্যই নিউজি এবং আপ-টু-ডেট হওয়া প্রয়োজন। কখন কোথায় কী ঘটছে, সব খবর মাথায় রাখা খুব বেশি জরুরি। সংবাদের মুডটা ধরতে পারা এবং মুড বুঝে পড়া খুব প্রয়োজন। এছাড়াও সময়জ্ঞান থাকা, দায়িত্বশীল হওয়া, আত্মবিশ্বাস, স্মার্টনেস, সাজসজ্জা পোশাকের জ্ঞান থাকা এবং অনেক ক্ষেত্রে উপস্থিত বুদ্ধি থাকাটাও বেশ প্রয়োজন আমার মতে।

আনন্দভুবন : সংবাদ উপস্থাপনা করতে গিয়ে কোনো বিব্রতকর অবস্থার সম্মুখীন হয়েছেন কি ?

জাকিয়া জাবের : খুব একটা বিব্রতকর কোনো পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি এখনো। তবে একবার অটোকিউ বা যেটা দেখে আমরা সংবাদ পড়ি, ওটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। আমাকে টানা তিন ঘণ্টার তিনটা বুলেটিন অটোকিউ ছাড়া, ল্যাপটপে থাকা স্ক্রিপ্ট দেখে এমনভাবে পড়তে হয়েছে যেন আমি আসলে অটোকিউ দেখেই পড়ছি। আমিও লাইন মনে রেখে রেখে এমনভাবে পড়েছিলাম, প্রডিউসার বলেছিলেন আমাকে দেখে বোঝাই যায়নি যে আমার সামনে অটোকিউ নেই।

আনন্দভুবন : সংবাদ উপস্থাপনার জন্য আলাদা কোনো প্রশিক্ষণ নিয়েছেন কী ?

জাকিয়া জাবের : হ্যাঁ, আমি লক্ষ্য নিউজ প্রেজেন্টেশন অ্যাকাডেমিতে কোর্স করেছি। সংবাদ উপস্থাপক হিসেবে আমাকে বা যেকোনো কাউকেই প্রতিষ্ঠিত করতে প্রতিষ্ঠান হিসেবে যতরকম সহযোগিতা করা সম্ভব, লক্ষ্য থেকে তার সবটাই করা হয়। লক্ষ্যের অবদান বলতে শুরু করলে শেষ হবে না।

আনন্দভুবন : সংবাদ উপস্থাপনার পাশাপাশি অন্য কোনো পেশায় যুক্ত আছেন কি ?

জাকিয়া জাবের : না, আমি এখনো শুধুমাত্র সংবাদ উপস্থাপনাই করছি, সেইসাথে পড়াশোনা করছি। পড়াশোনার পর্ব এখনো শেষ হয়নি। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগ থেকে এই বছর অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছি, এরপর এখান থেকেই মাস্টার্স করার ইচ্ছা আছে।

আনন্দভুবন : সংবাদ উপস্থাপনা নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী ?

জাকিয়া জাবের : আমার জীবনে খুব বেশি পরিকল্পনা করে কখনোই কিছু ঘটেনি। সংবাদ উপস্থাপনায় আসাটাও কখনো পরিকল্পনার মধ্যে ছিল না। জীবন নিয়ে যেভাবে পরিকল্পনা করি, বাস্তবে সেরকম কিছুই ঘটে না। তাই খুব দূরের পরিকল্পনা করা বাদ দিয়েছি। আমি একটা দিন সুন্দর করে বাঁচি, একটা দিন ধরে ধরে সামনে আগাই। আজকের দিনে আমি আমার সবচেয়ে সেরাটা দিয়ে কাজ করবো। নিজের কাজের প্রতি সৎ থাকবো। দিনশেষে নিজের মুখোমুখি যাতে নিজে হতে পারি। সেভাবেই কাজ করে যাচ্ছি এবং ভবিষ্যতেও যেতে চাই।

আনন্দভুবন : অবসরে কী করেন এবং কোথায় বেড়াতে যেতে পছন্দ করেন ?

জাকিয়া জাবের : অবসর খুব একটা পাই না সত্যি বলতে। পড়াশোনা চাকরি দুটোই একসাথে সমানতালে সামলাতে হচ্ছে। যেটুকু অবসর পাই, তখন গান শুনতে খুব পছন্দ করি, সিনেমা দেখতে পছন্দ করি। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে খুবই পছন্দ করি। আর বেড়াতে যাওয়া নিয়ে যদি বলি, বেড়াতে আমি খুবই পছন্দ করি কিন্তু বেড়ানো হয় খুবই কম। নৌকায় করে ঘুরতে খুব ভালো লাগে। সমুদ্রের কাছে যেতে ভালো লাগে। পাহাড় সেভাবে দেখা হয়ে ওঠেনি তবে পাহাড়ের সৌন্দর্যও খুব টানে আমাকে। সময় সুযোগ হলে বাংলাদেশ পুরোটা ঘুরে দেখার ইচ্ছা আছে। একদম ৬৪টা জেলার সব কয়টা।

আনন্দভুবন : প্রিয় খাবার ?

জাকিয়া জাবের : মায়ের হাতের সব খাবারই আমার প্রিয় খাবার।

আনন্দভুবন : আনন্দভুবনকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

জাকিয়া জাবের : আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ। সেইসাথে আনন্দভুবন এবং আনন্দভুবনের পাঠকদেরও অসংখ্য ধন্যবাদ। 

সাক্ষাৎকার : শহিদুল ইসলাম এমেল