নানা আয়োজনের মধ্যে দিয়ে বৈশাখ উদ্যাপন

24 Apr 2022, 01:32 PM খবর শেয়ার:
নানা আয়োজনের মধ্যে দিয়ে বৈশাখ উদ্যাপন

নানা আয়োজনের মধ্যে দিয়ে এবার উদ্যাপন করা হলো পয়লা বৈশাখ, বাংলা ১৪২৯ বঙ্গাব্দ। ১৪২৮ বঙ্গাব্দকে বিদায় জানিয়ে বাংলা বর্ষপঞ্জিতে যুক্ত হলো আরো একটি নতুন বছর। করোনা মহামারির কারণে গত দুই বছর সারাদেশে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান ঘরোয়া পরিবেশে উদ্যাপন করা হলেও এবার নানা আয়োজনের মধ্যে দিয়ে বাঙালি বরণ করে নিয়েছে নতুন বছরকে। পয়লা বৈশাখের ভোরে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন বছর ১৪২৯ বঙ্গাব্দকে স্বাগত জানানোর আয়োজনে মেতে উঠেছিল দেশবাসী। বর্ষবরণের এ বর্ণাঢ্য উৎসব আমেজে মুখরিত ছিল বাংলার চারদিক। গ্রীষ্মের খরতাপ এবং প্রচণ্ড গরম উপেক্ষা করে বাঙালি মিলিত হয় তার সর্বজনীন এই অসম্প্রদায়িক উৎসবে। দেশের পথে-ঘাটে, মাঠে, মেলায়, অনুষ্ঠানে ছিল কোটি মানুষের প্রাণচাঞ্চল্য।

১৪২৯ বঙ্গাব্দকে স্বাগত জানাতে আগের মতোই সকাল ৯টায় টিএসসি থেকে শুরু হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। ভোর ছয়টা ১৫ মিনিটে ছায়ানটের শিল্পীরা রবীন্দ্রনাথের ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’ গান দিয়ে শুরু করে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান।

নববর্ষ উপলক্ষে দেশের জাতীয় সংবাদপত্রগুলো বাংলা নববর্ষের বিশেষ দিক তুলে ধরে ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে। সরকারি এবং বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলো নববর্ষকে ঘিরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালা প্রচার করে। পয়লা বৈশাখে বাংলা নববর্ষ পালনের সূচনা হয় মোগল স¤্রাট আকবরের শাসনামল থেকে। সম্রাট আকবরই প্রথম বঙ্গাব্দ প্রবর্তন করেন। শুরুর দিকে পয়লা বৈশাখের আনুষ্ঠানিকতা কৃষক, জমিদার ও ভূ-স্বামীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। অবশ্য এ উপলক্ষে মেলা ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হতো।

নববর্ষ বরণে ব্যতিক্রমী এক উদ্যোগ নিয়েছে নড়াইলের প্রত্যন্ত অঞ্চলের তিন শতাধিক শিক্ষার্থী। সদর উপজেলার শেখহাটি গুয়াখোলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সাড়ে তিন শতাধিক শিক্ষার্থী ১৫ কিলোমিটার পথ বাইসাইকেল চালিয়ে ১১টি গ্রাম প্রদক্ষিণ করে বাংলা নববর্ষকে বরণ করে।

পয়লা বৈশাখে ভোরে বৈশাখি সাজে স্কুলড্রেস পরে বিদ্যালয় চত্বরে সমবেত হন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীরা সেজেছিলেন কৃষক, শ্রমিক, বাউলসহ নানা সাজে। বিদ্যালয় চত্বরে উপস্থিত হওয়ার পর শুরু হয় মুখে আলপনা আঁকা। তারপর সকাল ৮টায় প্ল্যাকার্ড ও ফেস্টুন হাতে নিয়ে ব্যতিক্রমী সাইকেল র‌্যালি বের হয়। সাড়ে তিন শতাধিক সাইকেল বহরের প্রথমেই ছিল শাড়ি পরিহিত ছাত্রীরা। এরপর স্কুলড্রেস পরিহিত ছাত্রী ও ছাত্রদের বহর। র‌্যালিটি গুয়াখোলা, হাতিয়াড়া, মালিয়াট, কমলাপুর, রঘুরামপুর, দোগাছি, বেনাহাটী, বাকড়ীসহ পার্শ্ববর্তী ১১টি গ্রাম প্রদক্ষিণ করে। এ সময় রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সাধারণ মানুষ হাত নেড়ে সাইকেল র‌্যালিকে উৎসাহ জোগায়।

ঋষিজ-এর বর্ষবরণ

শিশুপর্কের সামনে নারিকেলবীথি চত্বরে প্রতিবছর পয়লা বৈশাখে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের জন্য একটি মঞ্চ তৈরি হয়। শিশুর সরলতা নিয়ে একজন মানুষ মাতিয়ে রাখতেন সেই মঞ্চ। স্বরে-সুরে সহশিল্পীদের নিয়ে বরণ করতেন নতুন বছর। গাইতেন গণমানুষের গান। তিনি আর কেউ নন, গণমানুষের শিল্পী ফকির আলমগীর। এই প্রথমবার তাঁকে ছাড়া শাহবাগের মঞ্চে ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠীর বর্ষবরণ অনুষ্ঠান হলো। মঞ্চে গাওয়া হলো ফকির আলমগীরের বেশ কিছু গান। কেবল ছিলেন না তিনি। মরণব্যাধি করোনায় আক্রান্ত হয়ে গত বছরের ২৩ জুলাই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিলেন ফকির আলমগীর। ঋষিজের আয়োজনে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান শুরু হয় ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠীর শিল্পীদের সমবেত কণ্ঠে পরিবেশনার মধ্য দিয়ে। কেবল স্মৃতি হয়ে ছিলেন সংগঠনের দীর্ঘদিনের সভাপতি ফকির আলমগীর। তাঁর ও সদ্য প্রয়াত আবৃত্তিকার হাসান আরিফের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরব ছিলেন উপস্থিত সবাই। তারপর সরব হয়েছেন গানে, নৃত্যে ও কবিতায়, ফকির আলমগীরের সহধর্মিনী সুরাইয়া আলমগীরের সভাপত্বিতে অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন করেন রফিকুল আলম, ফকির শাহাবুদ্দিন, আরিফ রহমান, আবুবকর সিদ্দিক, সমর বড়–য়া, ফকির আলমগীরের ছোটো ভাই ফকির সিরাজ প্রমুখ। আবৃত্তি পরিবেশন করেন ইকবাল খোরশেদ ও অনন্যা লাবণী পুতুল।

গত বছরও এই মঞ্চে কোন কোন জ্যেষ্ঠ শিল্পী গাইবেন, কোন কোন তরুণ গাইবে, কোন কোন শিল্পীকে ঋষিজের সম্মাননা জানানো হবে, কোন সংগঠন কখন পরিবেশন করবে, সেসব ঠিক করে দিতেন ফকির আলমগীর। তাঁর প্রয়াণের পর সংগঠনের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন তাঁর স্ত্রী সুরাইয়া আলমগীর। সকালে বেলুন উড়িয়ে অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন।

দীর্ঘ ৪৫ বছর ফকির আলমগীর সংগঠনের হাল ধরে ছিলেন। ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে পয়লা বৈশাখের প্রথম সকালে শাহবাগের নারিকেলবীথি চত্বরে নববর্ষ উদ্যাপনের আয়োজন করেন। নাচ, গানসহ নানা আয়োজনে অগণিত মানুষের উপস্থিতিতে জমে ওঠে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান। ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠীর শিল্পীরা এবারও গেয়েছেন সমস্বরে। তবে, প্রতিটি মুহূর্তে তারা অনুভব করেছেন ফকির আলমগীরের অভাব। কেবল তারা নয়, উপস্থিত জনতাও অনুভব গণমানুষের শিল্পী ফকির আলমগীরের অভাব।