মঞ্চের বেগম সাহেবা

26 Feb 2025, 01:09 PM রঙ্গশালা শেয়ার:
মঞ্চের বেগম সাহেবা


থিয়েটারই যার ধ্যান, জ্ঞান, নেশা এমন একজন অভিনয়শিল্পী জেরিন কাশফী রুমা। একাত্তরের ক্ষুধিরাম, আসমান তারা শাড়ি, বাবা তার্তুফ, বাজিমাৎ, ভাগের মানুষ, শেষ সংলাপ, যযাতি প্রভৃতি মঞ্চনাটকে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। সময় সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর এই অভিনয়শিল্পীর অভিনয়জীবন, নাচের অনুশীলন, দেশে বিদেশে মঞ্চ-পরিবেশনা, প্রশিক্ষকদের নিয়ে স্মৃতিচারণ, নাটকের চরিত্র চিত্রণ, আগামীদিনের ভাবনা প্রভৃতি জানিয়েছেন তিনি...


চরিত্র চিত্রণ প্রসঙ্গে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে জেরিন কাশফী রুমা বলেন, ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র রূপায়ণের সুযোগ যখন আমার জীবনে এসেছে তখন নাট্যকারের সৃষ্টি এবং নির্দেশকের নির্মাণের দিকে ছিল আমার সব মনোযোগ। পাশাপাশি কো-আর্টিস্টের সহযোগিতা নিয়ে আমি চেষ্টা করেছি অভিনীত চরিত্রের আত্মা-সত্তা-বৈশিষ্ট্যে একীভূত হয়ে মঞ্চমায়ায় ফুটিয়ে তুলতে। এভাবেই একে একে করেছি ‘আসমান তারা শাড়ি’ নাটকে ‘আয়না বিবি’, ‘বাবা তার্তুফ’ নাটকে আলমারি, ‘বাজিমাৎ’ নাটকে ফুলবানু, ‘ভাগের মানুষ’ নাটকে লাইলী, ‘একাত্তরের ক্ষুধিরাম’ নাটকে শোভা, ‘শেষ সংলাপ’ নাটকে মহাতারেমা তথা বেগম সাহেবা, ‘যযাতি’ নাটকে দেবযানির মতো বেশকিছু চরিত্রে। এছাড়াও ‘সময়’ প্রযোজিত কিছু পথনাটক নিয়ে ঢাকা শহরসহ বাংলাদেশের নানান জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছি। আমার অভিনীত উল্লেখযোগ্য পথনাটকগুলো হলো ‘একটি নবজাতক শিশু’ ও ‘এবং কিন্তু’, ‘এখানে এখনো’, ‘জননী বীরাঙ্গনা’, ‘গণরায়’, ‘মৃত্যুঞ্জয়ী মানুষেরা’, ‘লক্ষ প্রাণের মূল্যে’, ‘যুদ্ধবাজ’ এবং ‘রেফারি’।

চরিত্র রূপায়ণে তার দৃষ্টিভঙ্গি নান্দনিক ও বিশ্বস্ত। একটু একটু করে হয়ে ওঠা অভিনেত্রীর মতো তিনি বলেন, আমার স্মৃতি এবং কল্পনার রঙে চরিত্রকে প্রাণে প্রতিষ্ঠা দিই। যেমন ধরেন, ‘আয়না বিবি’তে প্রেম-বিরহের রসায়ন, আলমারি চরিত্রে ভক্তি-ছলনার টানাপোড়েন, ফুলবানু চরিত্রে বিদ্রোহী সত্তা, লাইলী চরিত্রে দিশাহীনতার চূড়ান্তে পৌঁছানো, মহাতারেমা বা বেগম সাহেবা চরিত্রে দাম্ভিকতা মহানুভবতার সূক্ষ্ম রেখা নির্মাণ, শোভা চরিত্রে ক্ষুধিরামের বিশ্বস্ত সহপাঠী হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করা, দেবযানির আত্মসম্মান বোধ এমন সব ভাব মাথায় রেখে একটু একটু করে করতে করতে আস্ত চরিত্রটাকে একসময় দাঁড় করিয়ে ফেলা। প্রতিনিয়ত এই চরিত্রগুলোর সাথে আমাকে বসবাস করতে হয়েছে। চরিত্রগুলোর শরীরী ভাষা, ডায়ালগ থ্রোয়িংÑ এগুলো নিয়ে প্রচুর কাজ করতে হয়েছে, এখনো করে চলেছি।

নৃত্যশিল্পী হিসেবে দেশ এবং বিদেশে রয়েছে তার একাধিক একক এবং দলগত নৃত্য উপস্থাপনা। সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দেখুন একজন দক্ষ অভিনেত্রী হয়ে ওঠার স্বার্থে একটু কম-বেশি গান-নাচ জানা থাকা ভালো। দেশে বিদেশে নৃত্য নিয়ে প্রচুর কাজ রয়েছে আমার। দলগত কিংবা একক, দেশে কিংবা বিদেশে যখনই নাচ-গান পরিবেশন করেছি প্রথমেই দেশমাতৃকার বন্দনা এবং তারপর লোকনৃত্য ও কত্থকনৃত্যের পরিবেশনা করি। আমার নাচের এই চলার পথে সাজু আহমদ, আশরাফ উদ্দীন খান, হুদা ভাই, শামীম আরা নিপা, শিবলী মোহাম্মদ মন্টু ভাই প্রমুখ শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ যেটা পেয়েছি সেটাই আমার সম্পদ এবং সকলের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা আমার পরম প্রাপ্তি। তবে, সবকিছু ছাপিয়ে মঞ্চটাই আমার প্রাণ বলতে পারেন। একজন অভিনেত্রী হয়ে মঞ্চে দাঁড়ানোর আনন্দ থেকে বেশি আনন্দ আর কোনো কিছুতে পাইনি। আমি একজন ‘মঞ্চাভিনেত্রী’ এই পরিচয় দিতেই বেশি ভালোবাসি। মঞ্চনাটকে অভিনয় অন্যরকম আনন্দ দেয় একজন শিল্পীকে। সে আনন্দ ভাষায় বুঝিয়ে বলার মতো নয়।

অনেক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সাথে সম্পৃক্ততার সুবাদে অনেক সংগঠনে রয়েছে তার নিরবচ্ছিন্ন সাংস্কৃতিক কর্ম। এ-বিষয়ে তার প্রবল ইচ্ছাশক্তি এবং নিমগ্নতা এক অর্থে অনেকের কাছেই অনুকরণীয় এবং দৃষ্টান্তের। জেরিন কাশফী রুমা বিশ্বাস করেন, অনেক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সমান্তরাল দেশপ্রেম, জাতীয়তাবোধ এবং সাংস্কৃতিক বিকাশের বৃহত্তর কর্মযজ্ঞে আমি সবসময় সম্পৃক্ত। এখানে যে-বিষয়টি বলতে গিয়ে আমার অত্যন্ত ভালো লাগছে তা হলো বারিধারা ডিওএইচএস পরিষদের একজন গর্বিত সদস্য এবং কনভেনার হয়ে সংস্কৃতি অনুরাগীদের নিয়ে একটা বড়ো সময় ধরে অমর একুশ, বিজয়দিবস, স্বাধীনতাদিবস, পয়লা বৈশাখ তথা বাঙালির স্বকীয় সংস্কৃতির বহুমাত্রিক অনুষ্ঠান অত্যন্ত দক্ষতা-নিষ্ঠার সাথে সফলভাবে আয়োজন ও বাস্তবায়ন করেছি। পাশাপাশি মার্কস অলরাউন্ডারের সম্মানিত জুরি হয়ে ঢাকাসহ সারাদেশে বিচারিক কাজ করেছি।

মিশরীয় নাট্যকার তাওফিক আল হাকিমের ‘সুলতানুজ জান্নাম’ অবলম্বনে সৈয়দ জামিল আহমেদ ও ম. সাইফুল আলম চৌধুরীর যৌথ অনুবাদে, আক্তারুজ্জামানের নির্দেশনায় ‘শেষ সংলাপ’ নাটকের মহাতারেমা তথা বেগম সাহেবা চরিত্রটি অভিনেত্রী রুমাকে মঞ্চের ‘বেগম সাহেবা’ হিসেবে পরিচিতি পাইয়ে দেয়। নাটকে অনবদ্য অভিনয়গুলোর কারণে তিনি বিগত সময়ে একাধিক অ্যাওয়ার্ড ও সম্মাননা লাভ করেন। নাটক নিয়ে তিনি দেশে-বিদেশে প্রায় পাঁচ শতাধিক মঞ্চে অভিনয় করেন। পাশাপাশি নাচের দলগত ও একক উপস্থাপনা নিয়ে জাপান, জার্মানের মতো একাধিক দেশে ভ্রমণ করেছেন। সেই স্মৃতি সদাই জীবন্ত জেরিন কাশফী রুমার মননে। পথনাটক, মঞ্চনাটক মিলে অভিনীত চরিত্র তো কম হলো না। তবে, প্রত্যেকটি চরিত্র যেমন আমার কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ ঠিক তেমনি কিছু চরিত্র দর্শক-শ্রোতার কাছে তুলনামূলক অধিক গুরুত্বপূর্ণ। হয়ত সেই জায়গা থেকে একজন মিশরীয় নারী মহাতারেমা যে কি না বেগম সাহেবা হিসেবে নাটকে বারবার সমার্থক হিসেবে উচ্চারিত, যে সমাজকে বোঝে, ব্যবসার লাভ-ক্ষতি বোঝে, দরদাম করা বোঝে, ক্ষমতার জৌলুস বোঝে, যৌবনের প্রতাপ বোঝে, কুচক্রীদের কূটকৌশল বোঝে, মহানুভবতা বোঝে, আইন বোঝে এবং সর্বোপরি ক্ষমার মাহাত্ম্যও উপলব্ধি করে। ফলে দর্শক-শ্রোতা বেগম সাহেবারূপী রুমার অভিনয় মনে রাখেন অনেকদিন, হয়ত আজীবন। ফলে মহাতারেমা চরিত্রের রূপদানকারী হিসেবে হয়ত আমি তাদের মনের মাঝে জায়গা পেয়েছি। ফলে তারা যখন মেকআপ রুমে এসে কিংবা চলার পথে কখনো মহাতারেমা কিংবা কখনো বেগম সাহেবা নামে সম্বোধন করেন তখন আমার সত্যিই ভালো লাগে, তৃপ্তি লাগে। মনে হয়, অভিনয়জীবন বুঝি আমার সার্থক হলো। এই স্বার্থকতায় আমার দলপ্রধান এবং নির্দেশক আকতারুজ্জামানের অবদান অপরিসীম। মঞ্চে অভিনয়জীবনের শুরুতে সাইফুর রহমান মিরুনের অবদান আমার জীবন ও শিল্পকে সমৃদ্ধ করেছে।

বিভিন্ন মাধ্যমে অভিনয় করা নিয়ে অভিনেত্রী রুমার ভাবনা সহজ ও সাবলীল। তার বিশ্বাস, একজন অভিনয়শিল্পী নিঃসন্দেহে অভিনয়ের সব মাধ্যমে কাজ করবেন এটাই স্বাভাবিক। তবে, নিজের কথা যদি বলি তাহলে আমি মঞ্চে কাজ করতেই সবচেয়ে বেশি আনন্দ পাই। নিজের প্রযোজনাগুলোসহ বেছে বেছে কিছু কাজ করেছি। তবে, ভবিষ্যতে খুব ভালো কোনো গল্প পেলে তখন কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করব।

সম্প্রতি ‘কলের গান নান্দনিক অ্যাওয়ার্ড-২০২৪’-এর মঞ্চের শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী ক্যাটাগরিতে পুরষ্কার পেয়েছেন অভিনয়শিল্পী জেরিন কাশফী রুমা। অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্তি নিয়ে তার অভিব্যক্তি, আমার মঞ্চাভিনয় বলতে গেলে তিন যুগের। তিন যুগের এই অভিনয়জীবনে আমার অভিনীত চরিত্রের সংখ্যা কুড়ির অধিক। পথনাটক এবং মঞ্চনাটক উভয় ক্ষেত্রে আমার পদচারণা নিয়মিত এবং ধারাবাহিক। ফলে কলের গান মাল্টিমিডিয়ার মতো আয়োজক সংস্থার জুরি বোর্ড যখন সার্বিক বিবেচনায় আমাকে মনোনীত এবং নির্বাচিত করেন তখন সেটা আসলে আমার অভিনয়েরই মূল্যায়ন। দীর্ঘ অভিনয়-প্রস্তুতি, অনুশীলন এবং রূপায়ণের সর্বজনীন মূল্যায়ন। অসংখ্যের সাথে বিগত প্রাপ্তির মতো এই প্রাপ্তির আনন্দ অনুভূতির আদান-প্রদান আমার কাছে জীবনেরই উদ্যাপন।

অনেক পুরষ্কার নানান সময়ে তিনি পেয়েছেন। যেমন, শেষ সংলাপ নাটকের জন্য এসএ টিভি বেস্ট অ্যাকট্রেস অ্যাওয়ার্ডস, লোকনাট্য দলের পাঠাভিনয় শুভেচ্ছা স্মারক, অনির্বাণ একুশে নাট্যমেলা সম্মাননা, দৃষ্টিপাত নাট্যসংসদ শুভেচ্ছা স্মারক, দেশ বিদেশের নাট্যমেলা বহরমপুর, ভারত থেকে শেষ সংলাপ নাটকে মহাতারেমা চরিত্রে অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেত্রীর সম্মাননা।

এছাড়াও বাংলা সংস্কৃতিতে নানান অবদানের জন্য কলের গান স্টার অ্যাওয়ার্ড, একতা পারসোনালিটি অ্যাওয়ার্ড, বাংলা স্টার গোল্ডেন অ্যাওয়ার্ড, সুপারস্টার ডি এ তায়েব অফিসিয়াল ফ্যান ক্লাব সম্মাননা, এসএ টিভি কালচারাল পারসোনালিটি অ্যাওয়ার্ড। অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্তিতে আনন্দ যেমন হয়েছে তেমনি আনন্দ হয়েছে যখন জেনেছি আমি জুরি বোর্ডের দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হয়েছি। তবে, আমার কাছে সব থেকে বড়ো পুরস্কার দেশে কি বিদেশে যখন হল ভরতি দর্শক নাটক দেখতে আসেন, তখনকার সেই মুহূর্ত। হ

লেখা : মঈন আবদুল্লাহ