আলোচিত সিনেমা : ২০২৪

28 Jan 2025, 02:53 PM মুভিমেলা শেয়ার:
আলোচিত সিনেমা : ২০২৪

বলতে গেলে ২০২৪ ছিল সিনেমার জন্য আক্ষেপের বছর। বছরের শুরু থেকে জুন মাস পর্যন্ত সিনেমার ধারাবাহিকতায় মুক্তি পাচ্ছিল, কিন্তু বছরের মাঝখানের কয়েক মাস দেশে অস্থির পরিস্থিতির কারণে সিনেমা মুক্তি বন্ধ ছিল। তবে, বছরের শেষ দুই মাস নভেম্বর ও ডিসেম্বর মুক্তি পেয়েছে কয়েকটি সিনেমা। কিন্তু হলে তেমন দর্শক টানতে পারেনি। বিদায়ী বছরে ৫৩টি চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছে। বিস্তারিত লিখেছেন শেখ সেলিম...


২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ জানুয়ারি মেহেদী হাসান পরিচালিত ‘শেষ বাজি’ সিনেমা দিয়ে শুরু হয় নতুন বছর, শেষ হয় আকরাম খানের ‘নকশী কাঁথার জমিন’ দিয়ে। ব্যবসা বা শিল্পমানের বিচারের মধ্যে উল্লেখ করার মতো কাজ হয়েছে হাতেগোনা কয়েকটি সিনেমা। নূরুল আলম আতিক, গিয়াসউদ্দিন সেলিম, মোস্তাফিজুর রহমান মানিক, রায়হান রাফীর মতো পরীক্ষিত নির্মাতার সিনেমা যেমন ছিল, তেমনি ছিল মিশুক মনি, ধ্রুব হাসান, শঙ্খ দাশগুপ্তের মতো নবীন নির্মাতার সিনেমাও। ব্যবসায়িক দিক থেকে বছরের সবচেয়ে আলোচিত সিনেমা ছিল ‘তুফান’।

তুফান

ঈদুল আজহায় মুক্তি পায় ‘তুফান’। সমালোচকদের মতে, ‘এ সিনেমার মধ্যদিয়ে শাকিব নিজেকেই ছাড়িয়ে গেছেন।’ মুক্তির পরই দর্শকমহলে ভূয়সী প্রশংসা পায় ছবিটি। বিদেশে মুক্তি পেলে সেখানেও এই বাহবার চিত্র ছিল একইরকম। রায়হান রাফীর পরিচালনায় এতে শাকিব খানের বিপরীতে জুটি বাঁধেন কলকাতার মিমি চক্রবর্তী ও ঢাকার মাসুমা রহমান নাবিলা। অন্যান্য চরিত্রে রয়েছেন চঞ্চল চৌধুরী, রজত গাঙ্গুলি, গাজী রাকায়েত, ফজলুর রহমান বাবু, শহীদুজ্জামান সেলিম, মিশা সওদাগর, সালাউদ্দিন লাভলু, সুমন আনোয়ার প্রমুখ। চিত্রনাট্য করেছেন আদনান আদিব খান। বিভিন্ন সূত্রের বরাতে দেশীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, প্রায় ৩২ কোটি টাকার ব্যবসা করেছে ‘তুফান’। নির্মাতাও সিনেমাটি ‘ব্লকবাস্টার’ বলে ঘোষণা করেছেন।


রাজকুমার

ঈদুল ফিতরে দর্শক মাতিয়েছিল শাকিব খান অভিনীত এই সিনেমা। নির্মাতা হিমেল আশরাফের পরিচালনায় এতে ঢাকাই সুপারস্টারের সঙ্গে জুটি বেঁধেছেন মার্কিন অভিনেত্রী কোর্টনি কফি। একজন স্বপ্নবাজ তরুণের বাংলাদেশ থেকে আমেরিকা যাওয়ার গল্পে নির্মিত এ সিনেমায় উঠে এসেছে প্রেম ও পারিবারিক সম্পর্কের মতো বেশকিছু অনুষঙ্গ। এতে শাকিব খান ছাড়াও অভিনয় করেছেন তারিক আনাম খান, মাহিয়া মাহি, আরশ খান, ডা. এজাজ আহমেদ, এরফান মৃধা শিবলু প্রমুখ। সিনেমাটির প্রযোজনা সংস্থা ভার্সেটাইল মিডিয়ার সূত্রে জানা যায়, ‘রাজকুমার’ থেকে ২৬ কোটি টাকা গ্রস কালেকশন এসেছে।


দেয়ালের দেশ

রোজার ঈদে মুক্তি পায় ‘দেয়ালের দেশ’। যেখানে জুটি বাঁধেন শবনম বুবলী ও শরীফুল রাজ। এটি পরিচালনা করেছেন মিশুক মনি। চিত্রনাট্যও তারই লেখা। সরকারি অনুদানে নির্মিত এ সিনেমার গল্প এগিয়েছে, এতিমখানায় বড়ো হওয়া ‘বৈশাখ’ নামের এক যুবককে কেন্দ্র করে। বাসে বাসে লিফলেট বিলি করা এক মেয়েকে ভালো লাগে তার। ‘নহর’ নামের মেয়েটাও তার প্রেমে পড়ে। একপর্যায়ে সব হারিয়ে বৈশাখ কাজ নেয় মর্গে। একা একা মানুষটা নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে। হঠাৎ একদিন সেখানে একটা লাশ আসে। বৈশাখের মনে হয় লাশটা তার চেনা। বাক্শো খুলে দেখে এটা তার প্রেমিকা নহরের লাশ ! বিশেষ করে গল্পের জন্যই সিনেমাটি প্রশংসা কুড়িয়েছে। এছাড়া শবনম বুবলী ও শরীফুল রাজের অভিনয়ও ছিল মানানসই। সমালোচকদের কেউ কেউ সিনেমাটিকে ‘নিরীক্ষাধর্মী চলচ্চিত্র’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।


দরদ

সাম্প্রতিক বছরে উৎসব-উপলক্ষ ছাড়া প্রেক্ষাগৃহে শাকিব খান অভিনীত বিগ বাজেটের ছবির দেখা মেলেনি। তবে, এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম অনন্য মামুন নির্মিত ‘দরদ’। ১৫ নভেম্বর ২০২৪-এ মুক্তি পেয়েছিল এটি। যেখানে শাকিবের সঙ্গে জুটি বেঁধেছিলেন বলিউড অভিনেত্রী সোনাল চৌহান। মুক্তির পর প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত সিনেমাটি আলোচনায় থাকলেও দিনশেষে তেমন সাড়া ফেলতে পারেনি। গল্পে দেখা যায়, ছোটোবেলা থেকেই টিভিপর্দায় সরফরাজের সিনেমা দেখেন ফাতেমা। নিজের স্বামী দুলু মিয়ার মধ্যেও কল্পনার সেই সরফরাজের বৈশিষ্ট্য দেখতে চায় সে ! এছাড়া স্বামী দুলুর কাছে আবদার করে, জীবনে একবার হলেও সরফরাজকে সামনাসামনি দেখতে চায়। এমনই একটি গল্পে আবর্তিত হয়েছে দরদ। এতে শাকিব-সোনাল ছাড়াও অভিনয় করেছেন পায়েল সরকার, বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী, রাজেশ শর্মা, এলিনা শাম্মী প্রমুখ।


ওমর

শহরের প্রভাবশালী পরিবার মির্জা সাহেবের। তার বখাটে ছেলে ছোটো মির্জা। ঘটনাক্রমে সে খুন হয়। যখন খুন হয় তখন সেখানে উপস্থিত ছিল তারই ম্যানেজার ও একজন আগন্তুক। দেখা যায় যে, তারা পালিয়ে না-গিয়ে বরং মির্জা সাহেবের বাসায় উঠেছে। একদিকে কপালে চিন্তার ভাঁজ, অন্যদিকে দুইজনের মজার মজার খুনসুটিÑ এভাবেই এগিয়ে যায় সিনেমাটির গল্প। ঈদুল ফিতরে মুক্তির পর ‘ওমর’ ঘিরে বেশ আগ্রহ দেখা যায় দর্শকদের মাঝে। এতে অভিনয় করেছেন শরীফুল রাজ, নাসিরউদ্দীন খান, শহীদুজ্জামান সেলিম, ফজলুর রহমান বাবু, রোজি সিদ্দিকী, আবু হুরায়রা তানভীর, এরফান মৃধা শিবলু প্রমুখ।

এফডিসিকেন্দ্রিক নির্মাতাদের জন্য বছরটা ভালো যায়নি। একইধরনের গল্প, নির্মাণে অযতেœর ছাপ, প্রচারের অভাব মিলিয়ে কোনো সিনেমাই সেভাবে মনে রাখার মতো হয়নি। এর মধ্যেও কামরুজ্জামান রোমানের ‘লিপস্টিক’ ভালো চেষ্টা ছিল। আলোচনা-সমালোচনা হলেও কথা হয়েছে ‘জ্বীন-২’ নিয়ে।

‘দেয়ালের দেশ’, ‘ফাতিমা’, ‘প্রিয় মালতী’র মতো কয়েকটি সিনেমা, যারা অন্যরকম গল্প দেখতে চান, তাদের খোরাক মিটিয়েছে। চমকে দিয়েছেন মুহাম্মদ মোস্তফা কামাল রাজও। তার ‘ওমর’ বছরের অন্যতম বুদ্ধিদীপ্ত সিনেমা। অল্প বাজেট, গল্প অনুমেয় হলেও চিত্রনাট্য আর নির্মাণের জোরে যে উতরে যাওয়া যায়, সিনেমাটি সেটারই প্রমাণ।

বছর শেষের দিকে মুক্তি পায় ‘৮৪০’ সিনেমাটি। মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর এই রাজনৈতিক বিদ্রƒপধর্মী সিনেমাটি তেমন দর্শক টানতে পারেনি। ছবিটি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা করতে দেখা গেছে।

২০২৪-এ শরীফুল রাজের তিন সিনেমা [‘কাজলরেখা’, ‘দেয়ালের দেশ’ ও ‘ওমর’] মুক্তি পেয়েছে। তিন ধরনের চরিত্রে রাজ যথারীতি নিজের অভিনয় দক্ষতার ছাপ রেখেছেন। ‘ওমর’ ও ‘৮৪০’-এ নাসিরউদ্দিন খানও অভিনেতা হিসেবে নিজের জাত চিনিয়েছেন।

জিয়াউল রোশান, সাইমন সাদিক, নিরবের মতো বাণিজ্যিক সিনেমার পরিচিত নায়কের জন্য ২০২৪ ছিল গড়পড়তা বছর। তবে, আলাদাভাবে উল্লেখ করতে হয় আদর আজাদের কথা। লিপস্টিক-এ তিনি দেখিয়েছেন বাণিজ্যিক সিনেমার সফল নায়ক হওয়ার মতো গুণ তাঁর মধ্যে ভালোই আছে। রায়হান রাফীর ‘টান’ যারা দেখেছেন তারা জানেন, শবনম বুবলী অভিনয় ভালোই জানেন। কিন্তু অনেক সিনেমাতেই কেন যেন সেই বুবলীকে খুঁজে পাওয়া যায় না। ’২৪-এ মুক্তি পাওয়া দু’টি সিনেমা ‘মায়া : দ্য লাভ’ ও ‘রিভেঞ্জ’-এ বুবলী ছিলেন চলনসই। তবে, ভিন্নধারার সিনেমা ‘দেয়ালের দেশ’-এ অভিনেত্রী বুবলীকে পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ‘মায়া’ ও ‘দেয়ালের দেশ’ মুক্তি পেয়েছিল রোজার ঈদে। একইসময়ে একই অভিনেত্রীর দু’টি ভিন্নধারার সিনেমা চলেছে হলে।

জয়া আহসান অভিনীত ‘নকশী কাঁথার জমিন’ দিয়ে বছর শেষ হয়েছে। জয়া অভিনীত আরেকটি সিনেমা ‘পেয়ারার সুবাস’ বছরের প্রথমভাগে মুক্তি পায়। নূরুল আলম আতিকের সেই ছবিতে জয়ার অভিনয় দারুণ। তবে, সিনেমা হিসেবে এটা আরও ভালো হতে পারত।

পূজা চেরী বা ববির মতো বাণিজ্যিক সিনেমার নিয়মিত নায়িকাদের জন্যও বছরটা মোটামুটি কেটেছে। সবচেয়ে হতাশার, গেল বছর সেভাবে বাণিজ্যিক সিনেমার নতুন নায়িকা উঠে আসেননি।

ছোটোপর্দার জনপ্রিয় দুই তারকা মেহজাবীন চৌধুরী ও তাসনিয়া ফারিণের চলচ্চিত্রে অভিষেক হয়েছে। ‘ফাতিমা’য় ফারিণ ভালো করেছেন আর ‘প্রিয় মালতী’তে বছরের অন্যতম সেরা অভিনয় করেছেন মেহজাবীন।

মুক্তির কথা থাকলেও নানা জটিলতায় চলতি বছর বেশ কয়েকটি সিনেমা শেষ পর্যন্ত আসেনি। কোনোটির পোস্ট প্রোডাকশন শেষ হয়নি, কোনোটি কৌশলগত কারণে আসেনি, কোনোটি আবার রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে পিছিয়ে গেছে। চলতি বছর তাই আরিফিন শুভ, পরীমনি, নুসরাত ফারিয়া, আজমেরী হক বাঁধন, সিয়াম, তমা মির্জা অভিনীত কোনো সিনেমা মুক্তি পায়নি।

ছোটোপর্দার অভিনয়শিল্পী ইয়াশ রোহান ও কুসুম শিকদার অভিনীত ছবি ‘শরতের জবা’, এর বাইরে সুদীপ দীপ, ইরফান সাজ্জাদ, আইশা খান, মৌসুমী হামিদ, জাকিয়া বারী মম, নিদ্রা দে নেহা অভিনীত সিনেমা প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছে।