অবাক ঘটনা না ?
হ্যাঁ, বিস্ময়কর দৃশ্য, আমি তাকিয়ে আছি বিশাল সাদা কড়ইয়ের শেকড় আর রেল লাইনের কঠিন লৌহ গ্রাসের দিকে।
কে কাকে গ্রহণ করেছে ? রেল লাইন গ্রহণ করেছে গাছের শেকড় ? না শেকড় গ্রহণ করেছে রেল লাইনের লোহা ?
প্রশ্ন শুনে আমি তাকাই। পাশে দাঁড়িয়ে আছে লম্বা ছিপছিপে গড়নের এক নারী। শরীরের রং দুগ্ধফর্সা, গোলগাল মুখে, ওষ্ঠে কড়া লাল লিপিস্টিক, পরনে সাদা শাড়ি, মাথায় দীঘল চুল। বলা যায় সৌন্দর্যের ভেনাস। কিন্তু বিজন জায়গায় কীভাবে এলো হঠাৎ করে ? এই প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে সামনে অবাক নারী এলো কোত্থেকে ? বনে ঢোকার সময়ে ভেতরে ঢুকে সফরসঙ্গীদের রেখে আবার এই জায়গায় এলাম, আসার সময়ে আশেপাশে কাউকে দেখিনি। বনে কী বনপরী থাকে ? এই নারী কী বনপরী ?
আমি রেললাইন ছেড়ে তাকাই নারীর দিকে। আকর্ণ হাসি মুখে ধারণ করে আমার দিকে তাকিয়ে, আমি অতসী। ঢাকায় থাকি। আমরা কয়েকজন বেড়াতে এসেছি সিলেটে। একটু আগে এলাম এখানে কিন্তু বনে ঢোকার মুখে রেল লাইনের সঙ্গে বিশাল গাছের শেকড় জড়িয়ে গেল কীভাবে, কবে আমার জানার খুব কৌতূহল থেকে আবার এলাম জায়গায়।
আমি কাজল। আপনার মতো আমারও একই কেস। বউ কন্যা ভাগ্নি নিয়ে বেড়াতে এসেছি, সেই ঢাকা থেকেই। এবং আপনার মতো এই ধলা কড়ইয়ের শেকড়ের সঙ্গে রেললাইনের লোহা কবে ঢুকে গেছে, বুঝতে এসেছি।
বাহ! অতসীর মুখে অবাক আনন্দ।
আমার প্রশ্ন- আপনি দেখুন অতসী, এইখানে রেললাইন ছিল, কিন্তু কবে ? আমি এখানের বনরক্ষীদের জিজ্ঞেস করেছি, ওরা কিছুৃই বলতে পারল না।
সম্ভবত পাকিস্তানের সময়...
আমি মাথা নাড়ি, মনে হয় না। এই রেললাইন তৈরি হয়েছিল আরও আগে, ব্রিটিশের সময়ে।
হতে পারে কিন্তু, কিন্তু যুক্তি কী ?
আমার মোবাইল বাজে, পকেট থেকে বের করে দেখি মেয়ে পায়রার ফোন, হ্যালো ?
কী হলো মা ?
তুমি কোথায় গেলে ? আমরা ভেতরে ঢুকে গেছি আরও...
ঢুকতে থাকো, আমি আসছি। ফোন কেটে তাকাই অতসীর দিকে, আমার মেয়ে ফোন দিয়েছে। দৃষ্টি রাখি রেললাইনের উপর, এই গভীর বনে পাকিস্তানের সময় রেললাইন না হওয়ারই সম্ভাবনা বেশি। সাদা বেনিয়ার জাত ব্রিটিশরা যেখানে গেছে সেখানেই বাণিজ্য খুঁজেছে। এই অঞ্চলে নিশ্চয়ই ওদের শাসনের সুবিধার জন্য রেললাইন তৈরি করেছিল। ব্রিটিশরা যখন বুঝলো চলে যেতে হবে হাত গুটিয়ে উপমহাদেশ থেকে, সেই থেকে হয়ত এই রেললাইন পরিত্যক্ত হয়। আর এত ভেতরে পাকিস্তান সরকার বা স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার রেললাইন করবে না। কিন্তু সেই ১৯৪৭ সালের পর থেকে পরিত্যক্ত রেললাইনের উপর মহারাজার মতো জন্ম হয় এই সাদা কড়াইয়ের।
সাদা কড়ই মানে কী ? অতসী একটু অবাক।
গাছগুলোর নাম, আমাদের বরিশাল অঞ্চলের এই গাছগুলোকে সাদা কড়ই ডাকে।
লাল লিপিস্টিকে মাখানো থিরথির ওষ্ঠ কাঁপে অতসীর, আমি জানি না নাম এই গাছের।
সবার পক্ষে জানাও সম্ভব নয়।
রাইট, জন্ম থেকে আমি শহরের মেয়ে তো, তাই অনেক গাছপালা চিনি না। কিন্তু এই দৃশ্যটা অনেক দিন আমার স্মৃতির মধ্যে গেঁথে থাকবে।
এই বিশাল গাছগুলো দেখছেন, যে গাছের শেকড়ের মধ্যে কঠিন পাষাণ লোহার পাত ঢুকে গেছে অথবা বলা যায় একটু একটু করে রেললাইনের পাতের উপর শেকড়ের আগ্রাসন চালিয়ে দখলে নিয়েছে গোটা এলাকা এই সাদা কড়ই। জগতের সর্বত্র আগ্রাসন চলতেই থাকে, হোক সে মানুষ, প্রাণী, লোহার পাত কিংবা সাদা কড়াইয়ের শিকড়। আপনি কী বলেন ?
আমার মনে হয়, আপনার যুক্তিই ঠিক- এবং এতক্ষণে আমার মাথার জট খুলতে শুরু করেছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই গেল, কে আগে কাকে আক্রমণ চালিয়েছিল ? শেকড় না লোহার পাত ?
হঠাৎ প্রবল একটা বাতাস আসে গাছগুলো ডালপালা এড়িয়ে, অনেকটা আলিঙ্গনের প্রতারণায়। অতসীর শরীর পেঁচিয়ে রাখা সাদা শাড়ি বাতাসের সঙ্গে উড়ে যেতে চায়, ও সামলাতে চেষ্টা করে, সামনে দাঁড়ানো আমি দেখি ওর পিঠের সঙ্গে লেপ্টে থাকা সবুজ কামনা কামরাঙ্গার নির্মল পেট, নাভিমূল আর পেলব তলদেশ। শাড়ি সামলাতে সামলাতে আমার চোখে পড়ে ওর দৃষ্টি, দৃষ্টিতে যত না লাজুক আবেদন তার চেয়ে বেশি আহত আকুলতা। বাতাস চলে গেলে দ্রুত প্রতারক শাড়ি শরীরের সঙ্গে গেঁথে আমার দিকে তাকায়।
যুক্তি বলে রেললাইনের লোহার পাত পড়েই ছিল, সাদা কড়াইয়ের শেকড় জীবন্ত। এই শেকড়ই লোহার পাতকে আঁকড়ে ধরেছে।
মাথা নাড়ায় অতসী, একদম ঠিক বলেছেন।
সিলেটের লাউয়াছড়ার গভীর বনে ঢোকার মুখেই আমি এই দৃশ্য থেকে থমকে দাঁড়িয়েছিলাম। কিন্তু বউ আর কন্যার টানাটানিতে ওদের সঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করতে হয়। সত্যি, প্রকৃতির অপরূপ খেলার শেষ নেই। লাউয়াছড়ার যত ভেতরে যাই বিচিত্র ধরনের গাছপালা দেখি আর অভিভূত হই কিন্তু বাগানের মধ্যে ঢোকার মুখে ধলা কড়ই গাছের শেকড়ের মধ্যে রেললাইনের এই গেঁথে যাওয়া আমাকে ভীষণ অবাক করেছে।
বউ দীপা, কন্যা পায়না, ভাগ্নি স্বর্ণা, স্বর্ণার স্বামী নাদিম, ওদের পুত্র শুদ্ধ- আমরা একদঙ্গল বেড়াতে এসেছি সিলেটে। চারদিন ধরে ঘুরছি গোটা সিলেট, ঢাকা যাবার একদিন আগে আজকে এলাম লাউয়াছড়ায়। বনবিভাগ খুব যতœ করে সাজিয়ে রেখেছে।
আবার ফোন, আবার মেয়ে পায়রা- হ্যালো ?
তুমি আসছ না কেন ? ওর গলায় ভয়, আমরা মনে হয় পথ হারিয়েছি বাবা।
ওকে, আসছি- ফোন রেখে তাকাই অতসীর দিকে, আপনার সঙ্গে বিজন বনে দেখা হয়ে ভালো লাগল। আমার কন্যা বোধহয় পথ হারিয়েছে। যাই ?
ঘাড় নাড়ে অতসী, ওকে। আপনি আমার প্রশ্নের চমৎকার সমাধান দিয়েছেন, আপনাকে মনে থাকবে আমার অনেক দিন।
আমি দ্রুত পা ফেলে আমার বউ কন্যা ও আত্মীয়দের দিকে যেতে থাকি, যেতে যেতে অতসীর নাভিমূল আমাকে প্রলুব্ধ করতে থাকে কিন্তু যাচ্ছি পথ হারানো স্ত্রীর কাছে।
বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইটে সবার আগে উঠেছি চট্টগ্রাম এয়ারপোর্টে।
গত দুইদিন তিনরাত একটুও ঘুমুতে পারিনি। আমি আসতে চাইনি কিন্তু নাটকের ডিরেক্টর কমল হাসানের পীড়াপীড়িতে আসতে হলো। শুটিং সবসময়েই একটা বোরিং কাজ কিন্তু ডিরেক্টরেরা কীভাবে যে মাথা ঠান্ডা রেখে করে, বুঝতে পারি না। আমি নাটকের স্ক্রিপ্ট দিয়েই খালাস। তুমি বাবা ডিরেক্টর, সামলাও গে। কিন্তু কমল বলল, পাহাড়ি চু থাকবে আসুন।
চু থাকবে ? খুবই দুর্বল পয়েন্টে আঘাত লাগলে আর কিছু করার থাকে না। এলাম, শুটিং দেখলাম আর ফাঁকে চু ও মাংস খেতে খেতে কখন সময় পার হয়েছে, টেরই পাইনি। আরে বাবা, রাত চারটে পর্যন্ত চু’ খেলে সেই লোক ঘুমায় কখন ? শুটিং বাকি আর দু’দিন। ঢাকায় অনেক কাজ, টিকেট কেটে বিমানে উঠে পড়েছি। উঠেই সিট খুঁজে বেল্ট বাঁধার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়েছি। ঘণ্টাখানেক ঘুমানোর পর পাইলটের ঘোষণায় ঘুম ভাঙে এবং চোখ মেলে দেখি, পাশের সিটে সেই অতসী।
কেমন আছেন ? আমি অতসী। মনে পড়ে লাউয়াছড়ায়...
আমি আড়মোড়া ভাঙি, মনে আছে, খুব মনে আছে অতসীকে।
তাই ? মিষ্টি হাসে অতসী।
কেমন করে বলি, লাউয়াছড়ার গভীর বনে তোমার ওই নাভিমূল কোনো পুরুষের পক্ষে ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়, যদিও দেখেছি একপলক, কিন্তু দৃষ্টির কামনা জানালায় গেঁথে আছে অমৃত সুন্দরের চুম্বনের মতো।
অস্পরীর মতো মুখ ভুলে যাওয়া সম্ভব ?
জলের মতো হাসতে থাকে অতসী, সঙ্গে সঙ্গে বিমান রান ওয়ের উপর দৌড় শুরু করে। সবার সঙ্গে পেছনে সিটে মাথা এলিয়ে দিই। বিমান খাড়া নাক বরাবর উঠে যাচ্ছে। অতসীর এলোমেলো খোলা চুল আমার নাকে মুখে চুমু খাচ্ছে। কী অবিশ্রান্ত মিষ্টি ঘ্রাণ চুলের! অতসী চুলে নারকেল তেল মাখে, কতদিন মায়ের সেই নারকেল তেলের চুলের ঘ্রাণ আমাকে আবিষ্ট করে। অতসীর চুলের ঘ্রাণ নিতে নিতে আমি চুপ করে থাকি, হারিয়ে যাই শীতের দিনে, বোতলের ঠান্ডা নারকেল তেল উঠোনের রৌদ্রে শুকাতে দিতাম। ঢাকা টু চট্টগ্রামের পথে বিমান উড়তে উড়তে আমি ত্রিশ বছর আগের গ্রামীণ উঠোনে দাঁড়িয়ে কিন্তু পাশে সেই লাউয়াছড়ার অতসী।
আপনি কবে এসেছিলেন ? অতসীর প্রশ্নে ফিরে তাকাই অতসীর দিকে। চুল গুছিয়ে নিয়েছে নিজের খোঁপায়। বিমানবালিকা ছোট্ট একটা প্যাকেট আর ততধিক ছোটো পানির একটা বোতল দিয়ে যায়।
এসেছিলাম দু’দিন আগে, একটা টিভিনাটকের শুটিংয়ের জন্য।
আপনি অভিনয় করেন ? বিস্ময় খেলা করে অতসীর দুটি কালো চোখের তারায়।
হাসি, আরে না। অভিনয়ের দক্ষতা আমার নেই, আমি মাঝে মধ্যে দু’-একটা নাটকের স্ক্রিপ্ট লিখি।
আরও অবাক অতসী, আপনি লেখক ?
বিমানের দেয়া রুটির রুগ্ণ প্যাকেট খুলতে খুলতে হাসি, একটু আধটু।
কী লেখেন ?
গল্প, উপন্যাস, নাটক...
কী নামে লেখেন ? শুধু কাজল নামে ? নাকি অন্য নামে লেখেন ?
কাজল আফরান আমার পুরো নাম।
আসলে আমি শিল্প-সাহিত্যর তেমন খবর রাখি না তো, কিন্তু আমি লেখকদের খুব পছন্দ করি।
আপনি চট্টগ্রামে কেন এসেছিলেন ?
মিষ্টি কিন্তু রহস্যময় হাসি অতসীর মুখে, আমার একটা নিমন্ত্রণ ছিল।
কিসের নিমন্ত্রণ ?
অফিসিয়াল।
কোথায় চাকরি করেন আপনি?
আপনার মুখটা খুব ক্লান্ত লাগছে, ঘুমাননি আপনি ?
আমি বুঝতে পারি, অতসী নিজের পরিচয় দিতে চাচ্ছে না। হয়ত কেনো সমস্যা আছে। মানুষ তো বাস করে অন্তহীন সমস্যার মধ্যে। ছয় মাসের মধ্যে চলতি পথে অতসীর সঙ্গে আমার দুবার দেখা হলো, অতসী কি আমার সম্পর্কে ভেবেছে ? কখনো কামনা করেছে ? কিন্তু আমি তো মনে মনে ওকে অনেকবার ভেবেছি, লাউয়াছড়ার সেই দৃশ্য সিনেমার পর্দা কাঁপানো দৃশ্যের মতো আমার মানসপটে প্রদর্শিত হচ্ছে। ওর স্বামী কী করে ? নিশ্চয়ই স্বামী সন্তান নিয়ে জমজমাট সংসারের মধ্যমণি অতসী।
কী বলবেন না কথা আমার সঙ্গে ? অতসী অনেকটা ঝুঁকে এসেছে আমার দিকে।
সত্যি বলতে কী, এখানে আসার পর আমি চুয়ে নিমজ্জিত ছিলাম। ঘুম বিশ্রাম তেমন হয়নি, তাই আমাকে ক্লান্তু লাগছে। ঢাকার বাসায় ফিরে একটা ঘুম দিলে ঠিক হয়ে যাবে।
চু ?
চু হচ্ছে পাহাড়িদের ঘরে ঘরে তৈরি একধরনের অ্যালকোহল।
হাসে অতসী, আমিও খাই মাঝেমধ্যে কিন্তু চু তো বলে না। বলে বাংলা।
রাইট, ঢাকা নগরে আমরা বাংলা বলি কিন্তু আদিবাসীরা চু বলে। আবার গোষ্ঠীভেদে ওদের মধ্যে আলাদা নাম আছে। কোনো কোনো গোষ্ঠী বলে দোচোয়ানি।
অনেক অভিজ্ঞতা আপনার ?
মাথা ঝাকাই আমি, আদিবাসীদের সঙ্গে আমার একটা যোগাযোগ আছে। কয়েকজন লেখক বন্ধুও আছে, বছরে একবার হলেও আসি এই অঞ্চলে। সে কারণে, টুকটাক অভিজ্ঞতা রয়েছে আমার।
পাইলটের ঘোষণা ভেসে আসে, বিমানের যাত্রীবৃন্দ, আমরা আর কিছুক্ষণের মধ্যে ঢাকা এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করব। আমাদের সঙ্গে ভ্রমণের জন্য আপনাদের ধন্যবাদ জানাই।
আমার মনে হলো একটা কলা ছিলে খেতে-না-খেতেই বিমানের যাত্রা শেষ হয়ে গেল। মনটা আমার খারাপ- অতসীর প্রতি একধরনের মমত্ব বা অনুরাগ জমে উঠেছে। এত সুন্দর মসৃণ আর দীঘল বক্ষের নারী সাধারণত চোখে পড়ে না। আমার স্ত্রী খুবই ভালো কিন্তু একঘেয়েমির মধ্যে পড়ে আছি গত বিশ বছর ধরে। সুযোগ পেলে একটু টেস্ট কী বদল করা যায় না ? আমি আমার মধ্যে একধরনের লোভী শেয়ালের লেজ আবিষ্কার করি। নিজের প্রতি ঘৃণাই লাগছে। বিমান থেকে একসঙ্গে নেমে আসি। কিন্তু নামার পরই দেখতে পেলাম অতসীর মধ্যে তীব্র চাঞ্চল্য। ভেবেছিলাম, আজকে মোবাইল নাম্বারটা চেয়ে নেব।
বিমান ল্যান্ড করেছে প্রায় লাউঞ্জের পাশেই। নেমেই অতসী আমার দিকে তাকায়, আসি ?
আমাকে কোনো বাক্য উচ্চারণের সুযোগ না দিয়ে দ্রুত চলে যায় লম্বা পা ফেলে ফেলে। আমি তাকিয়ে দেখি, চোখের তিমির পার হয়ে কীভাবে চলে যায় প্রজাপতি! বুকের মধ্যে একধরনের হাহাকারের বাঁশি বাজে। নিজেকে বেয়াকুফ মনে হলো, একজন নারী অতসী, হতে পারে সুন্দরী, হতে পারে নান্দনিক কিন্তু আমার কী আসে যায় ? জীবনে মাত্র দুদিন দেখা হলো...
নিজেকে ধিক্কার জানিয়ে লাউঞ্জের দিকে হাঁটতে থাকি আমি।
তোর ভাবির সঙ্গে আমি বিয়ের আগে তোদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এত আড্ডা দিয়েছি যে, এই এলাকার কোনো ঘাসের উপর পা রাখতে বাকি নেই!
তাই নাকি ? অবাক চোখে তাকায় আমার দিকে সবুর খান। তখন আমি কোথায় ছিলাম ? তোর সঙ্গে দেখা হলো না কেন ?
কেমনে হবে, তুই তো তখন টাংকি মারছিস তোর বৌ, তখনকার প্রেমিকা মিস মালবিকা মৌসুমীর সঙ্গে।
আমাদের আলাপের মধ্যে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সমীর আহমেদ, আহারে! কেবলই ভদ্র ছিলাম।
আমরা হাসিতে ফেটে পড়ি।
সবুর খান গল্পকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি’র অধ্যাপক। দু’বছর আগে ছিল বিভাগের চেয়ারম্যান। ফারসি ভাষায় অনন্য অনুবাদক শাকির সবুর। ইরানের প্রচুর লেখেকের গল্প অনুবাদ করে বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে ছড়িয়ে দিয়েছে। সমীর আহমেদ গল্পকার। সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করে। ইতোমধ্যে নারায়ণগঞ্জে বাড়ি বানিয়েছে। সমীর নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকায় এলে সবুর আর আমাকে ফোন দেয়। ব্যাটে বলে মিলে গেলে আমরা টিএসসিতে বসে আড্ডা মারি। সেই আড্ডায় হলিউডের অড্রে হেপবার্ন, সোফিয়া লোরেন, বলিউডের মীনাকুমারী, বৈজয়ন্তীমালা, ওয়াহিদা রেহমান থেকে হালের দীপিকা পাড়–কুন পর্যন্ত আমাদের আলোচনায় জায়গা পায়।
দীর্ঘশ্বাস ফেলার কোনো কারণ নেই সমীর, সামাজিকভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছ, আর কী চাই ?
আমার সমর্থনে শাকির হাসে, ঠিকই বলেছে কাজল। এই বয়সে নারায়ণগঞ্জে একটা ছয়তলা বাড়ির মালিক, কম কী ?
খালি বাড়িটাই দেখলা, সমীর আহত গলায় প্রতিউত্তর করে, আমার কষ্টটা দেখলা না ?
ঢাকা শহরের ধারে বাড়ি করবা চান্দু, মালিক হইবা আর কষ্ট করবা না, এইডা তো অয় না- আমি চোস্ত বরিশালের বাক্য ঢুকিয়ে দিই।
শাকির সবুর হাসিতে ফেটে পড়ে, সঙ্গে আমিও তাল দিই। সমীর ঢেকুর তোলে। আমরা কিছুক্ষণ আগে শাকির সবুরের শিক্ষক লাউঞ্জে গিয়ে গরুর মাংসের কাবাব আর রুটি খেয়ে এসেছি। সমীর ঢাকায় এলে তিনজনে মিলে সবুরের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে সবুরকেই ভাঙ্গি। আনন্দ লাগে, আমাগো শাকির সবুর হাসি মুখে বন্ধুদের অত্যাচার মেনে নেয়।
আপনি এখানে ?
আমরা হাসি থামিয়ে তাকাই। সামনে দাঁড়িয়ে অতসী। একটু আগে সন্ধ্যা নেমেছে ঢাকা শহরে। টিএসসির আলো ও আঁধারের মধ্যে শহীদ মিলনের স্মৃতি স্মারকের সামনের ফুটপাতের বেঞ্চে বসে আড্ডায় ডুবে আছি। এই সময়ে অতসীকে দেখব, ভাবিনি। অন্ধকারের আলোয় অসামান্য সুন্দরের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অতসী। শাকির সবুর এবং সমীর আহমদ তথৈবচ। আমি নিজেও কম অবাক হয়নি, সন্ধ্যার ক্ষণ পার হয়ে রাত্রির প্রথম প্রহরে টিএসির মোড়ে অপরূপ অতসীর দেখা পাব, সাত আসমানের তারা পাওয়ার মতো ঘটনা।
হ্যাঁ আমি আর আমরা। আড্ডা দিচ্ছি, বসুন না অতসী- আমি সরে জায়গা দেই।
বিনা ওজরে আমার পাশে বসে অতসী। বিদেশি সেন্টের গন্ধে আমরা দিশেহারা। সমীর আর শাকিরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। আমরা টুকটাক গল্পে মেতে উঠি। অতসীকে জিজ্ঞেস করি, এখানে এই সময়ে কোত্থেকে এলেন ?
পুরোনো ঢাকায় গিয়েছিলাম আমার ব্যবসার এক ক্লায়েন্টের সঙ্গে। কাজ শেষ করে চলে এসেছি। যাবার সময়ে আপনাকে দেখে থামলাম।
অতসীর উত্তরে শাকির প্রশ্ন করে, কীসের ব্যবসা আপনার ?
এক্সপোর্ট ...
সমীর তাকায় মুগ্ধ চোখে, ইমপোর্ট করেন না ?
না, আমার কোম্পানি শুধু এ´পোর্ট করে।
সমীরের মোবাইলে ফোন আসে, ফোন রিসিভ করে সমীর চুপচাপ শুনে মোবাইল কেটে তাকায়, আমার বাসায় যেতে হবে। অবশ্য সমীর দূরে নারায়ণগঞ্জে যাবে, আগে থেকেই যেতে চাইছিল। আমরা ওকে টেনে রাখছি, আরে বাবা পুরোনো বউ, বাসায় কী করবেডা কী ?
ছেলেটা বড়ো জ্বালায় রে বন্ধু!
খোঁচা দেয় শাকির, শেষ বয়সে ছেলে হলে ওই রকমই হয়।
আচ্ছা, যাও।
সমীর উঠে দাঁড়ায়, তাকায় নিরীহ চোখে অতসীর দিকে, ভালো থাকবেন। আবার দেখা হবে।
হাত নাড়ে অতসী।
সমীর চলে যায়।
আপনি কী ঢাকা ইউনিভারসিটির ছাত্রী ছিলেন ?
অতসী ঘাড় নাড়ে, না আমি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছি। পড়াশুনার মধ্যেই বিয়ে হয়ে যায়। আমার হাজব্যান্ড চাকরি করে একটা বেসরকারি ব্যাংকে। আমাদের দুটো ছেলে, বড়টা কলেজে ফাস্ট ইয়ারে, আর ছোটোটা নাইনে।
আমি বুঝতে পারি শাকিরের মুখ বন্ধ করার জন্য একসঙ্গে নিজের আদি-অন্তু বলে থামিয়ে দিয়েছে। শাকিরও চুপ।
চা খাবেন ? টিএসসির প্রবাহিত যৌবনের নীরবতা ভেঙে আমি জানতে চাই অতসীর কাছে।
চা ? একটু সময় নিয়ে জবাব দেয় অতসী, খাওয়া যায়।
তাহলে চলুন মূল টিএসসির দিকে, উঠে দাঁড়ায় শাকির।
আমরা তিনজনে রিকশা গাড়ি আর মানুষের ¯্রােত অতিক্রম করে টিএসসির মধ্যে ঢুকে এক পরিচিত চাঅলার সামনে দাঁড়াই। আমি নিই আদা মিশ্রিত রং-চা। শাকির আর অতসী নেয় দুধ-চা। ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আমরা আবার গল্পে মেতে উঠি। শাকিরের ছেলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিমান চালনার প্রশিক্ষণ নিতে গেছে, আমার মেয়ে পায়রা বিবিএ পাশ করে ব্যাংকে ঢোকার চেষ্টা করছে। সীমান্তেু ইন্ডিয়ার বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশের মানুষ হত্যা, ফিলিস্তিনে ইসরাইলের নৃশংস মানুষ হত্যা...। শাকিরের ফোন আসে বাসা থাকে, বোঝা যাচ্ছে বৌকে কৈফিয়ত দিচ্ছে এত রাতে বাসার বাইরে কেন টাংকি মারছে। ফোন ছেড়ে তাকায় আমার দিকে, কী ব্যাপার কাজল ? রাত তো দশটার কাছাকাছি, বাসায় যাবার ইচ্ছে নেই কেন ?
বুঝতে পারি অতসীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক দেখে, খানিকটা ঈর্ষায় জ্বলছে। তা জ্বলুক। কিন্তু আমি তো জানি, অতসী ধরা-ছোঁয়ার বাইরের এক কোকিল।
বললাম, তোর ভাবি আর মেয়ে গেছে বেড়াতে। আসাবে দুদিন পর। খালি বাসায় কী করব ? তাই সময় কাটাচ্ছি।
তুই অতসীর সঙ্গে সময় কাটা, আমি যাচ্ছি- দু’জনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দ্রুত চলে যায় শাকির সবুর। সবুর চলে যাওয়ার পর তাকিয়ে দেখি, টিএসসির লোকজন ইতেমাধ্যে অনেকটা কমে এসেছে। হলের ছাত্রছাত্রীরাই মূলত এখন আড্ডা মারছে, গল্প করছে, ছেলে মেয়েরা সিগারেট টানছে।
চলুন, যাওয়া যাক, আমি বলি অতসীকে।
হ্যাঁ চলুন।
আমরা দু’জনে টিএসসি থেকে বের হয়ে ধীরে ধীরে হাঁটছি শাহবাগের দিকে। আমি জানি না অতসীর বাসা কোথায়। অবাক লাগছে, রাত দশটা বাজছে কিন্তু অতসীর বাসায় ফেরার তাগিদ নেই। চুপচাপ সময় কাটাচ্ছে আমার সঙ্গে। হয়ত স্বামী গাড়ি নিয়ে আসবে, সেই অপেক্ষা করছে। আমার কিন্তু বেশ লাগছে রাতের এই আলো-অন্ধকারে একজন অপরূপ অতসীর সঙ্গে হাঁটতে। কী মরাল গ্রীবা, চৌকস শরীর। চোখের তারায় নৃত্য করছে লাউয়াছড়া বাগানের নাভিমূলের আগুনলাগা দৃশ্য। নিজেকে নিজে গালি দিই, শুয়োর রে তুই একটা আস্ত শুয়োর। অতসীকে দেখলেই তুই লোভী শেয়ালের মতো ছোক ছোক করিস।
আমরা জয়নুল কামরুল কিবরিয়া সফিউদ্দিন কাইউম রনবীর চারুকলা পার হয়ে শাহবাগের মোড়ে এসে পৌঁছাই। রাত সাড়ে দশটা। বাসায় যাওয়ার একটা অটো গাড়ি খুঁজছি আমি। শাহবাগের চাপাশের উদ্ভাসিত আলোয় অতসীকে মোহনীয় লাগছে। বারেবারে ফিরে তাকাই আর ভাবি, ওর স্বামী কী ওকে ...
আমি কিন্তু আপনার সঙ্গে যেতে পারি, পাশে দাঁড়িয়ে মৃদু কণ্ঠে বলে অতসী।
বিস্ময়ের সঙ্গে তাকাই, কোথায় যাবেন আমার সঙ্গে ?
কেন ? আপনার সঙ্গে আপনার বাসায় যাব- খুব স্বাভাবিক হাসি অতসীর মুখে, আপনার স্ত্রী কন্যা তো বাসায় নেই। প্রতিরাতে আমার রেট দশ হাজার টাকা। কিন্তু আপনার কাছ থেকে কোনো টাকা নেব না। কারণ, একজন লেখকের সঙ্গে রাত্রি যাপন আমার অনেক দিনের শখ। বলতে পারেন, এই রাতটা আপনাকে উপহার দেব আমি।
মুহূর্ত মাত্র, আমার মনে হলো শাহবাগের মোড়ে কোনো আলো নেই, চারদিকের থকথকে ভয়ার্ত অন্ধকার আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলছে। সেই থকথকে অন্ধকারের মধ্যে অতসী দাঁড়িয়ে আছে অবিশ্রান্তু এক মোমের পুতুল। হ
অলঙ্করণ : স্ব. সরকার