বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪, এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানিয়েছে, ‘বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত যুক্তরাজ্য প্রবাসী ফুটবলার হামজা দেওয়ান চৌধুরী বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের হয়ে খেলার আনুষ্ঠানিক অনুমতি পেয়েছেন।’
এর আগে প্রথমে হামজা বাংলাদেশে খেলার জন্য নিজের ইচ্ছা প্রকাশ করেন, এরপর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেওয়া হয়। যার ফলে চলতি বছর বাংলাদেশের পাসপোর্ট হাতে পান হামজা চৌধুরী।
ইংল্যান্ডের ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সবুজ সংকেত এবং সবশেষ ফুটবল বিশ্বের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফার অনুমোদন পেয়েছেন হামজা। এবার লাল সবুজ জার্সি গায়ে বাংলাদেশের জাতীয় দলের হয়ে মাঠে নামা হামজা চৌধুরীর জন্য সময়ের ব্যাপার মাত্র।
শৈশব থেকেই শুরু হয়েছিল হামজার পথচলা, লেস্টার সিটির আলোয় বিকশিত হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু রক্তের টান, পূর্বপুরুষের ডাকে, একদিন ফিরতেই হলো তার আপন ভুবনে। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে এখন তিনি বাংলাদেশ জাতীয় দলের গর্ব, এক নতুন অধ্যায়ের নায়ক।
বাংলাদেশি শেকড় আর ব্রিটিশ সংস্কৃতির মিশেলে গড়ে ওঠা এই ফুটবল যোদ্ধা লেস্টার সিটির সবুজ মাঠে নিজের নাম লিখিয়েছেন সোনার হরফে। তিনি শুধু একজন ফুটবলার নন, তিনি এক অনুপ্রেরণার নাম।
হামজা দেওয়ান চৌধুরী তার ক্যারিয়ার শুরু করেন ব্রিটিশ ক্লাব লেস্টার সিটি একাডেমিতে ২০১১-’১২ মৌসুমে খেলার মধ্যে দিয়ে। ফুটবলে তার অসাধারণ নৈপুণ্যের জন্য মাত্র ১৬ বছর বয়সে শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি ইউরোপিয়ান ক্লাবের নজরে আসেন। ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ ফেব্রুয়ারি, তিনি লিগ ওয়ান ক্লাব বার্টন আলবিয়নে ১ মাসের জন্য ধারে খেলার জন্য চুক্তিভিত্তিক যোগ দেন। ওই একই দিনে, তিনি ব্রিটিশ ফুটবল লিগেও নিজেকে আত্মপ্রকাশ করেন। যেখানে ৭৭তম মিনিটে টম নেয়লরের বদলি হিসেবে মাঠে নামেন হামজা। অবশ্য ইংল্যান্ডের বার্টনে অবস্থিত ফিরেল্লি স্টেডিয়ামে ওয়ালশালের বিপক্ষে ম্যাচটি ০-০ গোলে ড্র হয়। বার্টন আলবিয়নে তিনি দুই মৌসুম খেলেন। দুই মৌসুমে তিনি ২৬টি ম্যাচ খেলেন।
২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের ৬ আগস্ট, হামজা আবারো বার্টন আলবিয়নের সঙ্গে ২০১৬-’১৭ মৌসুমের জন্য ধারে খেলার চুক্তি করেন। ওই দিনই তিনি বার্টনের হয়ে প্রথমবারের মতো ফুটবল লিগ চ্যাম্পিয়নশিপে মাঠে নামেন। যেখানে নটিংহাম ফরেস্টের বিপক্ষে একটি গোল করতে সহায়তা করেন। যদিও তার দল ৪-৩ ব্যবধানে পরাজিত হয়। ২০১৭-’১৮ মৌসুমে, তিনি বার্টন আলবিয়নের হয়ে ধারের খেলা শেষ করে পুনরায় লেস্টার সিটিতে ফিরে আসেন।
২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ মার্চ, হামজার লেস্টার সিটির হয়ে অভিষেক হয়, ইএফএল কাপের তৃতীয় রাউন্ডে লিভারপুলের বিপক্ষে। খেলার ৮২তম মিনিটে মাঠে নেমে তিনি দলের জয়ে অবদান রাখেন। যা তাদের হোম গ্রাউন্ডে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ২০২২-’২৩ মৌসুমে তিনি ধারে লেস্টার সিটি থেকে ইংরেজ ক্লাব ওয়াটফোর্ডে যোগ দেন।
এরপর ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ মে তোলুন টুর্নামেন্টে চীন অনূর্ধ্ব-২১-এর বিরুদ্ধে ২-১ গোলে জয়ের প্রধান কারিগর হামজা। যার ফলস্বরূপ হামজা দেওয়ান চৌধুরী ইংল্যান্ড জাতীয় অনূর্ধ্ব-২১ ফুটবল দলের হয়ে আত্মপ্রকাশ করেন। তিনি ইংল্যান্ডের হয়ে টুর্নামেন্টের পরবর্তী ম্যাচে মেক্সিকোর বিপক্ষে ০-০ গোলে ম্যাচ ড্র দিয়ে শুরু করেন।

২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ মে তাকে ২০১৯ উয়েফা ইউরোপীয় অনূর্ধ্ব-২১ চ্যাম্পিয়নশিপের জন্যে ইংল্যান্ডের ২৩ সদস্যের দলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু ফ্রান্সের কাছে প্রথমার্ধে ২-১ গোলে পরাজয়ের সময় একটি বেপরোয়া ট্যাকলের জন্য তাকে সোজা লাল কার্ড দেখানো হয়।
বাংলাদেশ এবং গ্রেনাডার প্রতিনিধিত্ব করার জন্য হামজা চৌধুরী ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবরে আগ্রহ প্রকাশ করেন। এরপর ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ ফেব্রুয়ারি কিছু রিপোর্ট নিশ্চিত করে তিনি ২০২৬ বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের জন্য বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলে যোগদান করার ব্যাপারে আলোচনায় ছিলেন। এরপর ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ আগস্ট, তিনি বাংলাদেশি পাসপোর্ট পান। ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ সেপ্টেম্বর ইংলিশ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন তাকে একটি অনাপত্তি সনদ [ঘঙঈ] প্রদান করেন এবং তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার অনুমতি দেন।
বাংলাদেশের স্বপ্নের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয় ! এখন বিশ্ব দেখবে বাংলাদেশের ফুটবলে এক নতুন বীরের উত্থান !
হামজা দেওয়ান চৌধুরীর জন্ম পয়লা অক্টোবর ১৯৯৭। তিনি ইংল্যান্ডের লেস্টারশায়ারের লাফবারায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ পেশাদার ফুটবল খেলোয়াড়। তার মা বাংলাদেশি এবং বাবা গ্রেনাডিয়া। বাংলাদেশে ইউরোপিয়ান ফুটবলপ্রেমীদের কাছে হামজা বেশ পরিচিত নাম। লেস্টার সিটির যুব দল থেকে উঠে এসে বর্তমানে ক্লাবের মূল দলে নিয়মিত খেলছেন এই প্রতিভাবান মিডফিল্ডার। তিনি ইংল্যান্ডের ইএফএল চ্যাম্পিয়নশিপের ক্লাব শেফিল্ড ইউনাইটেডের হয়ে খেলেন। এছাড়া এখন তিনি বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়। হামজার মা রাফিয়া চৌধুরী বাংলাদেশের হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার স্নানঘাট ইউনিয়নের দেওয়ানবাড়ি গ্রামের মেয়ে। ছেলেবেলায় হামজা প্রায়ই গ্রামের বাড়িতে যেতেন।
২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে হামজা চৌধুরী বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন অলিভিয়া ফাউন্টেনের সঙ্গে। বিয়ের পর অলিভিয়া ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং তার নাম পরিবর্তন করে অলিভিয়া চৌধুরী রাখেন। হামজা ও অলিভিয়া এক কন্যা ও দুই পুত্র সন্তানের গর্বিত পিতা-মাতা।
বাংলাদেশ ফুটবলে হামজার অন্তর্ভুক্তি শুধু প্রযুক্তিগত উন্নতি নয়, বরং এটি দেশের তরুণ ফুটবলারদের জন্য এক অনুপ্রেরণার উৎস হতে পারে ফুটবল বিশেষজ্ঞদের এমনটাই ধারণা।