ডায়াবিটিস এমন একটি রোগ যা নিয়ন্ত্রণে না থাকলে রোগী হৃদরোগ, কিডনি-রোগসহ নানারকম মৃত্যুঝুঁকিপূর্ণ রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। তবে, জীবনযাপনে ইতিবাচক পরিবর্তন এনে এবং খাদ্যাভ্যাস বদল করে ডায়াবিটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা খুব একটা দুরূহ কাজ নয়। বর্তমান নিবন্ধে আমরা ডায়াবেটিস রোগীর ওষুধ, পথ্য ও মিষ্টিজাতীয় খাবারের বিকল্প নিয়ে আলোচনা করবো।
ডায়াবেটিস রোগীর ওষুধ
ডায়াবেটিস দুই ধরনের হতে পারে- টাইপ-১ ডায়াবেটিস, টাইপ-২ ডায়াবেটিস
টাইপ-১ ডায়াবেটিস
এই ধরনের ডায়াবেটিসে শরীরে ইনসুলিন তৈরি হয় না। তাই রোগীকে ইনসুলিন ইনজেকশন নিতে হয় আজীবন।
ইনসুলিনের ধরন
Short-acting [Regular Insulin]
Intermediate-acting [NPH Insulin]
Long-acting [Glargine, Detemir]
Premixed insulin [Mixtard, Humalog Mix ইত্যাদি]
ইনসুলিনের ডোজ ডাক্তার রক্তে শর্করার মাত্রা অনুযায়ী নির্ধারণ করেন।
টাইপ-২ ডায়াবেটিস
এই ধরনের রোগীর শরীরে ইনসুলিন থাকলেও তা ঠিকমতো কাজ করে না। চিকিৎসা শুরু হয় ওষুধ ও জীবনধারায় পরিবর্তন এনে।
সাধারণত ব্যবহৃত ওষুধসমূহ
১ . Metformin [মেটফরমিন]
প্রথম ধাপের সবচেয়ে প্রচলিত ওষুধ। যেমন : Gluformin, Metform, Glucophage.
এটি ইনসুলিনের কার্যকারিতা বাড়ায়।
২. Sulfonylureas [সালফোনাইল ইউরিয়া গ্রুপ] যেমন : Glimiperide [Amaryl], Glibenclamide [Daonil]. এটি অগ্ন্যাশয়কে ইনসুলিন তৈরি করতে উদ্দীপিত করে।
৩. DPP-4 inhibitors. যেমন : Sitagliptin [Januvia), Vildagliptin (Galvus]
৪. SGLT2 inhibitors. যেমন : Dapagliflozin [Forxiga], Empagliflozin [Jardiance].
এটি প্রস্রাবের মাধ্যমে অতিরিক্ত গ্লুকোজ বের করে দেয়।
৫. GLP-1 receptor agonists [ইনজেকশন]। যেমন : Liraglutide [Victoza], Dulaglutide [Trulicity].
৬. ইনসুলিন [যদি প্রয়োজন হয়]। অনেক টাইপ-২ রোগীকেও পরবর্তীসময়ে ইনসুলিন নিতে হয়।
ডায়াবেটিস রোগীর খাবার-দাবার কেমন হবে
বৈচিত্র্যময় খাবার খাওয়া : প্রতিদিন একই ধরনের খাবার না-খেয়ে, নানান রকমের ফলমূল, শাকসবজি ও কিছু শ্বেতসার-জাতীয় খাবার খেতে পারলে ভালো। যেমন : লাল চালের ভাত ও লাল আটার রুটি।
যেসব খাবার কমিয়ে দিতে হবে : চিনি, লবণ ও চর্বিজাতীয় খাবারের পরিমাণ একেবারেই কমিয়ে দিতে হবে, অর্থাৎ যতটুকু না-খেলেই নয় ঠিক ততটুকুই খেতে হবে।
সময়মত খাবার খেতে হবে : প্রতিদিন সকালের নাশতা, দুপুরের ও রাতের খাবার সময়মতো খেতে হবে। কোনো বেলার খাবার যেন বাদ না পড়ে। আপনার যদি খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়, সেক্ষেত্রে প্রতিসপ্তাহে একটু একটু করে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করুন। এভাবে পরিবর্তন আনা আপনার জন্য সহজ হবে। একেবারে সম্পূর্ণ খাদ্যাভ্যাস বদলে ফেলার চেষ্টা না করাই ভালো।
ডায়াবেটিস রোগীর খাদ্য তালিকায় যা থাকতে পারে
একটি স্বাস্থ্যকর ও সুষম ডায়েটের জন্য পাঁচটি প্রধান গ্রুপ বা পদের খাবার খাওয়া প্রয়োজন। সেগুলো হলো :
শ্বেতসার সমৃদ্ধ খাবার। যেমন : লাল বা বাদামি চালের ভাত, লাল আটার রুটি বা পাউরুটি।
প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার। যেমন : ডিম, মাছ, মাংস, শিম ও অন্যান্য বীন, ডাল, বিভিন্ন ধরনের বাদাম।
দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার। যেমন : দই, ছানা ও পনির।
ডায়াবেটিস রোগী যে-সব ফল ও শাকসবজি খেতে পারবেন
দিনে একফালি বাঙ্গি বা এককোষ জাম্বুরা খাওয়া যাবে, সাথে একটু টকদই মিশিয়ে নেওয়া যেতে পারে। যেকোনো ধরনের মৌসুমি ফল খাওয়া ভালো। খিচুড়ি, পাস্তা ও অন্যান্য রান্নায় গাজর, মটরশুঁটি, বরবটি ও শিম ব্যবহার করা যেতে পারে। ভাতের সাথে মটরশুঁটি, মাংসে বেশি করে পেঁয়াজ যোগ করা যেতে পারে। কম শর্করাযুক্ত শাকসবজির উৎস হিসেবে মাশরুম, শশা, পালংশাক, বাঁধাকপি, ফুলকপি, ব্রকলি ও লেটুস খাওয়া যেতে পারে। বরই ও তরমুজ কম শর্করাযুক্ত ফলের ভালো উৎস। বিদেশি ফলের মধ্যে আভোকাডো, পিচ ও বিভিন্ন বেরি খাওয়া যেতে পারে।
যা খাওয়া যাবে না
সাদা চাল, সাদা আটা, পাউরুটি, মিষ্টি, চিনি, মিষ্টান্ন, আইসক্রিম, কোমল পানীয় [যেমন- কোক, পেপসি ইত্যাদি], তেলে ভাজা খাবার, চিপস, পরোটা, বেগুনি, গোরুর মাংস ও চর্বিযুক্ত খাবার, অতিরিক্ত লবণ ও মশলা।
২. খাবারের সময় ও নিয়ম
দিনে ৫-৬ বার অল্প অল্প করে খাবেন [৩টি মূল খাবার + ২-৩টি হালকা খাবার]। কখনোই দীর্ঘ সময় না-খেয়ে থাকবেন না। প্রতিদিন একই সময়ে খাবার গ্রহণের চেষ্টা করুন। খাবারের আগে ও পরে রক্তে গ্লুকোজ পরীক্ষা করলে খাবারের প্রভাব বোঝা যায়।
ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য মিষ্টিজাতীয় খাবারের বিকল্প
ডায়াবিটিস রোগী স্যাকারিন, অ্যাসপার্টাম, স্টেভিয়া। প্রাকৃতিক মিষ্টি ফল, ফলের রস, যেমন কলা বা আপেল ব্যবহার করা যেতে পারে। ডার্ক চকোলেট এবং মিষ্টি ছাড়া টকদইও বিকল্প হিসেবে ভালো। কারণ, এগুলো রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
পরামর্শ
খাদ্যাভ্যাসে পর্যাপ্ত পরিমাণে ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার যেমন শাকসবজি, ডাল এবং ফল অন্তর্ভুক্ত করুন। প্রক্রিয়াজাত খাবার এবং অতিরিক্ত চিনিযুক্ত পানীয় এড়িয়ে চলুন।
ডায়াবেটিস রোগীর ইনসুলিন কী এবং কেন জরুরি
ডায়াবেটিস রোগীর জন্য ইনসুলিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হরমোন, যা শরীরের রক্তে শর্করার [গ্লুকোজ] মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। এটি মূলত অগ্ন্যাশয় [Pancreas]-এর বিটা কোষ [B-cells] থেকে উৎপন্ন হয়। ইনসুলিনের কাজ হলো- রক্তের গ্লুকোজকে কোষে প্রবেশ করিয়ে শক্তি উৎপাদনে সহায়তা করা। আরো সহজভাবে বললে ইনসুলিন একটি প্রাকৃতিক হরমোন, যা শরীরের কোষকে নির্দেশ দেয়-
“রক্তে থাকা গ্লুকোজ [চিনি] গ্রহণ করো এবং শক্তি হিসেবে ব্যবহার করো।” যখন এই ইনসুলিন যথাযথ পরিমাণে তৈরি না-হয় বা শরীর তা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে না, তখন রক্তে অতিরিক্ত গ্লুকোজ জমে যায়- এটিই হলো ডায়াবেটিস [Diabetes]।
ইনসুলিন কেন জরুরি
#. ইনসুলিন না থাকলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যায়, যা চোখ, কিডনি, স্নায়ু ও হৃদযন্ত্রের ক্ষতি করে।
#. গ্লুকোজ কোষে প্রবেশ না-করলে শরীর দুর্বল হয়, ক্লান্তি আসে, ওজন কমে যায়।
#. নিয়মিত ইনসুলিন নেওয়া ডায়াবেটিসজনিত জটিলতা [যেমন রেটিনোপ্যাথি, নিউরোপ্যাথি, কিডনি ফেইলিউর] থেকে রক্ষা করে।
কোন রোগীদের ইনসুলিন প্রয়োজন হয়
# টাইপ-১ : ডায়াবেটিস রোগীর শরীর একদমই ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না, তাই জীবনভর ইনসুলিন নিতে হয়।
#. টাইপ-২ : ডায়াবেটিস রোগীকে প্রথমে সাধারণত ট্যাবলেট [oral medicine] দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, কিন্তু পরবর্তীসময়ে যখন শরীর ইনসুলিনের প্রতিক্রিয়াশীলতা হারায়, তখন ইনসুলিন প্রয়োজন হয়।
#. গর্ভকালীন ডায়াবেটিস [Gestational Diabetes]
গর্ভাবস্থায় কিছু নারীকে সাময়িকভাবে ইনসুলিন নিতে হয়। কারণ, অনেক ওষুধ তখন নিরাপদ নয়।
ইনসুলিনের প্রকারভেদ
#. Rapid-acting insulin : দ্রুত কাজ করে, খাবারের আগে নেওয়া হয়
#. Short-acting insulin : খাবারের আগে বা পরে নেওয়া যায়
#. Intermediate-acting insulin : সারাদিনের জন্য ধীরে ধীরে কাজ করে
#. Long-acting insulin : ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত স্থায়ী প্রভাব রাখে
ইনসুলিন নেওয়ার সুবিধা
রক্তে শর্করা স্থিতিশীল রাখে। জটিলতা কমায়। জীবনের মান উন্নত করে।
সতর্কতা
ইনসুলিন নেওয়ার আগে রক্তে শর্করার মাত্রা পরীক্ষা করা উচিত
ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ডোজ পরিবর্তন করা বিপজ্জনক
ইনসুলিন ঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে হবে [সাধারণত ঠান্ডা স্থানে, ২-৮°C তাপমাত্রায়]