নাফাখুম অভিযান : সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

23 Nov 2025, 02:10 PM ভ্রমন শেয়ার:
নাফাখুম অভিযান : সৈয়দা তাসলিমা আক্তার


[পূর্ব প্রকাশিতের পর]


২০১৫ নাফাখুম যাত্রার অসামপ্ত গল্পটি সমাপ্ত করার জন্য ২০১৬ সালে আবার পথে নামলাম। এবার দৃঢ় চিত্ত, যাই ঘটুক-না-কেন নাফাখুম অভিযান পূর্ণ করতেই হবে। দৃঢ়তার সাথে এবার আমরা অভিযাত্রীরাও সংখ্যায় বেশি, সেইসাথে গত বারের ব্যর্থ অভিযান থেকে জমিয়ে রাখা অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝেছিলাম, বান্দরবান শহরে আমরা কোনো সময় নষ্ট করবো না, নাশতা করেই থানচির পথে বেরিয়ে পড়বো। এবার লক্ষ্য স্থির, তাই বাস থেকে নেমে ফ্রেস হয়ে আমরা নাশতা করতে বসে পড়লাম, এদিকে নাশতা পরিবেশনের ফাঁকে একদল চলে গেল চান্দের গাড়ি ভাড়া করতে, এখানে অবশ্য কিছুটা সিস্টেম লস হয়েছিল, প্রথমে আমরা খরচের কথা ভেবে বাসের টিকেট কেটেছিলাম, পরে হিসেব করে দেখা গেল, এতে সময়ের অপচয় অনেক বেশি হবে। তাই আবার সেই চান্দের গাড়িতেই ফিরে গেলাম। মনে একটা সূক্ষ্ম ইচ্ছে ছিল যদি বেলাবেলি পৌঁছাতে পারি তবে থানচিতেও থাকবো না, রেমাক্রি চলে যাবো। তবে, পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথকে খুব একটা ভরসা করা যায় না। এছাড়া পথের বিভিন্ন জায়গায় চেকিং পয়েন্টগুলোতে বাধ্যতামূলকভাবে থামতে হয় এবং আবশ্যিক আনুষ্ঠানিকতায় সময় নেহায়েত কম লাগে না।

সকাল ৮টা ৩০মিনিটে আমরা বান্দরবান শহর ছেড়েছি। গাড়ি ছুটছে চঞ্চল গতিতে কখনো মেঘ ছুঁয়ে কখনো মেঘ মাড়িয়ে। সকালে উদীয়মান সূর্যকে সাথি করে আমরা পথ চলতে শুরু করি। সময়ের সাথে সাথে সূর্যের প্রখরতা কখনো কখনো চোখ ধাঁধিয়ে দিলেও মেঘ এসে যেন আবার দৃষ্টিতে প্রাশান্তির ছোঁয়া দিয়ে যায়। এই রোদ-মেঘের লুকোচুরির খেলার সাথি আমরা, কেউ কেউ নিজের মনে গান ধরে, কেউ আবার গলা মেলায়- যদিও বেসুরো তবুও যে পাহাড়ের ছন্দময় আবহে তা সুরেলা মনে হয়। আর পাহড়ের যে একটি নিজস্ব ভাষা আছে- ‘ঝুমঝুম’, কান পাতলেই শোনা যায়। গম্ভীর পাহাড়ের নীরবতা ভাঙানোর যে ভাষা তা শুধু পথ চলতি পথিকই শুনতে পায়। এর সাথে মিলেমিশে যেকোনো কথাই ছন্দময় রূপ নিয়ে গান হয়ে ওঠে। চলতি পথে কুড়িয়ে পাওয়া বারো আনা হিসেবে বান্দরবানের রূপসী কন্যা নীলগিরিতে আমরা একটু থামলাম, রূপসী কন্যার সাথে কিছুক্ষণ গালগপ্পো করবো বলে। যদিও বলেছিলাম কিছুক্ষণ থাকবো, কিন্তু নীলগিরির অপরূপ সাজ মনের অজান্তেই আমাদের দেরি করিয়ে দিলো। প্রায় ঘণ্টাখানেক কাটিয়ে দিলাম নীলগিরির অতিথি হয়ে।

আমরা যখন থানচি পৌছুলাম তখন বেলা দুপুর গড়িয়ে বিকেলের ভাগে চলে গেছে। থানচি পৌঁছে সেদিনকার মতো থাকবার একটি ডেরা খুঁজে নিয়ে বাক্শোপ্যাটরা রেখে একটু ফ্রেস হয়ে নিয়েই বেরিয়ে পড়ি খাবারের খোঁজে। তখন দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছিল, সবার পেটেই ক্ষুধা তার নিজস্ব রাজ্য গড়ে তুলেছে। তাই গদ্যময় ক্ষুধা নিরাময়ই ছিল তখন মুখ্য। কাছেই একটা হোটেলে ঢুকে পড়লাম অনাহুতের মতো। যেহেতু বেলা গড়িয়ে যাচ্ছিল তাই খুব বেশি বাছবিচারের সুযোগ নেই- ডাল, ডিমভাজা, সবজি আর সাদা ভাতই তখন অমৃত।

পেট ঠান্ডা হলে আমাদের নয় সদস্যের অভিযাত্রী দলের মধ্যে অনেকেই সেদিন রেমাক্রি যাওয়ার জন্য উদগ্রীব। কিন্ত আমিই বাধ সাধি। কেননা, একে তো অচেনা জায়গা, তারপর পাহাড়ি পাথুরে নদী, পৌঁছাতে কতটা সময় লাগবে, থাকার জায়গাটই-বা কেমন হবে- এসব ভেবে তাই সেদিন রেমাক্রি না গিয়ে থানচি থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। খাওয়া দাওয়া শেষে ডেরায় ফিরে কিছুটা বিশ্রাম নেওয়ার পর অফুরন্ত সময় পুরোটা বিকেলজুড়ে। পরদিন ভোর ভোর নাও ভাসবে। তাই এ বেলায় গাইড ও নৌকা ঠিক করে নেওয়া হলো আর আমাদের গাইড আবুল যে কি না পাহাড় বাওয়া থেকে নৌকা চালোনা, মাছ ধরা থেকে রান্না করা সব কাজে পারদর্শী। সে স্বপ্রণোদিত হয়ে ঝরা বিকালে আমাদের নিয়ে গেল ‘সেগুন ঝিরি’ দেখাবে বলে। আমরা বেরিয়ে পড়লাম সে এক জটিল অভিজ্ঞতা। পাথুরে নালায় পা ডুবিয়ে হেঁটে চলা চলতি পথে প্রকৃতির অদ্ভুত অপূর্ব রূপ দেখতে দেখতে হঠাৎ এক ঝপাৎ শব্দ, ঘাড় ফেরাতেই দেখি দলের একজন আছাড় খেয়েছে, ভাগ্য ভালো খুব বেশি চোট লাগেনি। তবে, সেই ছিল প্রথম। তারপর পুরো পথ পাড়ি দিয়ে ‘সেগুন ঝিরি’ যাওয়া এবং আসার মধ্যে দলের প্রত্যেকেরই এক-আধবার আছাড় খাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে। আনন্দ এবং শঙ্কাময় এক অনুভূতি নিয়ে কাদায় মাখামাখি আমরা যখন ফিরলাম, ততক্ষণে সূর্য রক্তিম রং ধারণ করেছে।

আমাদের থানচির আবাস একটি ঢালু পাহাড়ের মাথায় যে-কারণে ওঠা-নামায় বেশ দম খরচ করতে হয়। তাই সবাই মিলেই ঠিক করে নিলাম ফ্রেস হয়ে একেবারে রাতের খাবার খাওয়ার জন্য নিচে নামবো, সাথে সকালের নাশতার ফরমায়েশটাও দিয়ে আসবো। কেননা, পরদিন খুব ভোরে আমাদের রেমাক্রির পথে যাত্রা করতে হবে। আমরা খুব ভোরেই তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম, থানচি বাজারে সকালের নাশতা সেরে নিয়ে তারপর সরাসরি নৌকায়। দুটি ছোটো নৌকায় আমরা ৯ জন, সাথে মাঝি ও দুজন গাইড। একজন বাঙালি, নাম আবুল, যার কথা আগেই বলেছি। অন্যজন স্থানীয়, নাম উসাও। উসাও অবশ্য আমাদের সাথে যোগ দিয়েছে তিন্দু বাজার থেকে, তার আগ পর্যন্ত আবুলই ছিল আমাদের একমাত্র কা-ারী।

এখানে একটি কথা বলে রাখি, বড়ো নৌকায় রেমাক্রি যাওয়া সম্ভব নয়। কেননা, কিছু কিছু জায়গা পাথরের মাঝ দিয়ে সংকীর্ণ পথ পাড়ি দিতে হয়, তাই ছোটো নৌকাই সম্বল। শুরু হলো পানিপথের যাত্রা। যদিও তখন গ্রীষ্মের শেষ তবুও যেন ভোর কুয়াশায় ঢাকা। আমরা ধীরে ধীরে কুয়শার চাদর সরিয়ে পথ পাড়ি দিচ্ছি। সমস্ত চরাচরজুড়ে এক মৃদু ঘুঙুরের শব্দ আর নৌকার ইঞ্জিনের গুনগুন আওয়াজের এক অদ্ভুত অপূর্ব আবেশে আমরা ভেসে চলেছি আর অবাক হয়ে প্রকৃতি রূপের এক একটি পাতা উল্টাচ্ছি। ধীরে ধীরে সূর্যের উদয়ে প্রকৃতির কুয়াশার চাদর সরে গিয়ে কোমল রুপালি আলো নদীর জলে প্রতিফলিত হচ্ছে ; মনে হচ্ছে সবুজ জলে হঠাৎ রুপোর ঝিলিক উঁকি দিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। সাঙ্গু নদীর পানির শীতল অনুভব যেন সারাজীবন মনে রাখার মতো- কখনো জলে হাত ভেজাচ্ছি, কখনো পা। জলের ওপর ভাসতে ভাসতে হঠাৎ আমাদের চোখ আটকে যাচ্ছে নিঃসঙ্গ কেনো পাহাড়ি বাড়ির ওপর। মনে হচ্ছে যেন পটে আঁকা ছবি। প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টার পথ আমরা নৌকায় ভাসছি- প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ, প্রায় নির্বাক হয়ে। মাঝে অবশ্য মিনিট পনেরোর যাত্রাবিরতি ছিল। তারপর আবার নৌকায়। একটানা এতটা পথ চলছি কিন্তু ক্লান্তি আমাদের সঙ্গী হতে পারেনি। ছবির মতো পথ, মাঝে মাঝে পাথুরে চাঁই, কখনো ঝুরি বটের মতো নাম না-জানা কোনো গাছের অদ্ভুদ ভঙ্গি আর চেনা-অচেনা পাখির কলধ্বনি- সব যেন মিলেমিশে একাকার। আবার একটু থামলাম, রাজার সাথে দেখা হলো বলে কথা! বলছিলাম রাজাপাথরের কথা। জায়গাটা বড়ো অদ্ভুত যেন পাথরদের বিধান সভা কিংবা সংসদ। সভপতিত্বে আছেন রাজাপাথর, বিশাল গম্ভীর আর রাজকীয় তার ভঙ্গিমা। আরও বিভিন্ন আকৃতির পাথর যারা সভাসদ তারাও গম্ভীর হয়ে বসে আছেন এখানে ওখানে। পাথুরে রাজত্বে খানিকক্ষণ কাটিয়ে ফের নাও ভাসালাম বেলা প্রায় ১২টা নাগাদ- অবশেষে আমরা আমাদের এবারকার গন্তব্য রেমাক্রিতে পৌঁছলাম।

রেমাক্রিতে থাকার জন্য পাহাড়িদের নিজস্ব আদলের বাড়িই ভরসা। অবশ্য ব্যবস্থা মন্দ নয়। ছবির মতো কাঠের ঘর, পাটি বিছানো মেঝে, ঘরে বিছানাপত্র আর শতরঞ্জি ছাড়া আর কোনো আসবাব নেই, আর রয়েছে চমৎকার একটি বারান্দা। এখান থেকেই পাহাড়ি জীবনের একটি চিত্রকে এঁকে নেওয়া যায়। সাঙ্গু নদী দিয়ে চলমান ছোটো ছোটো নৌকোগুলো যেন তাদের বাণিজ্যতরী সবক’টা নৌকোই পণ্যে বোঝাই, শুধু পর্যটকদের নৌকো ছাড়া। একটু সময় আমরা বারান্দাতে বসেই কাটিয়ে দিলাম, পাহাড়ের প্রায় নিঃশব্দ বৈচিত্র্য উপভোগ করে নিলাম। এর মধ্যে অবশ্য আমার আমাদের পরবর্তীপরিকল্পনা ঠিক করে নেওয়া হলো। সকাল থেকে প্রায় একটানা জার্নিতে এ বেলায় সকলেই কম-বেশি ক্লান্ত। তাই একমাত্র কাজ ক্লান্তিকে ছুটি দেওয়া। সবাই প্রস্তুত। এতক্ষণ যার কথা বলবো বলবো করে বলা হয়নি সেটা হচ্ছে ঝিরি- ‘রেমাক্রি ঝিরি’, যে-ঝিরির কারণে রেমাক্রি জায়গাটি বিখ্যাত।

ও আচ্ছা, ঝিরির কথা আগেও বলেছি, কিন্তু ঝিরি আসলে কী জিনিস তা বলা হয়নি। ঠিক তো ? ঝিরি আসলে ঝরনার ছোটো বোন। তবে রেমাক্রি ঝিরিটা কিন্তু অত ছোটো নয়। আমার কাছে তো বেশ বড়োই মনে হলো। যাই হোক, আমরা আর সময় নষ্ট না-করে ঝিরির পথে পা বাড়ালাম। খুব বেশি পথ নয়, আর এখনে নদী প্রায় খালের মতো। হাঁটু সমান পানি আমরা হেঁটেই পৌঁছে গেলাম। প্রথমে একটু ভয় ছিল পিচ্ছিল পথের আগের বিকেলের অভিজ্ঞতা তো কম ছিল না। তবে, ভয়টা ছিল, এটা ক্ষণিকের। জলের ছোঁয়া পেতেই আমরা সবাই জলপরি হয়ে উঠলাম। তারপর যে কোথা দিয়ে ঘণ্টা দুই কেটে গেল তার হিসাব নেই। সেই যে সাত-সকালে নাশতা করে বেরুলাম এখন বেলা প্রায় আড়াইটা। খাওয়ার কথা যেন কারও মনেই নেই। দলে যিনি আমাদের মুরুব্বি ছিলেন, তার তাড়াতেই একসময় আমাদের জলকেলি থামলো। অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে এলাম। অবশ্য তখনই মনে মনে ভেবে নিলাম, বেলা ডোবার আগে আবার আসবো। ঘরে ফিরে ফ্রেস হয়ে দুপুরের খাবার খেতে চললাম। [আগামী পর্বে সমাপ্য]