অলঙ্কারের নতুন ভাষা

23 Nov 2025, 02:20 PM অভোগ শেয়ার:
অলঙ্কারের নতুন ভাষা

একসময় অলঙ্কার মানেই ছিল সোনা, রুপা, হীরা বা মুক্তার ঝলক। সমাজে গয়না ছিল সামাজিক অবস্থান, ঐশ্বর্য আর পারিবারিক ঐতিহ্যের প্রতীক। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই ধারণা পাল্টে গেছে। এখন অলংকার মানে শুধু ধন-সম্পদের প্রদর্শন নয়- বরং এটি হয়ে উঠেছে স্বকীয়তা, নান্দনিকতা ও টেকসই ফ্যাশনের প্রতীক। বিশ্বজুড়ে, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এখন দেখা যাচ্ছে এক নতুন ধারা- প্রাকৃতিক, হস্তনির্মিত ও পুনর্ব্যবহৃত উপকরণে তৈরি গয়না। এসব অলংকারে যেমন আছে স্থানীয় ঐতিহ্যের ছোঁয়া, তেমনি রয়েছে পরিবেশবান্ধব সৃজনশীলতা। বিভিন্ন ধরনের গয়নার গল্প নিয়ে এবারের অঁভোগ আয়জন...



মাটির অলঙ্কার

বাংলার মাটি শুধু কৃষকের জীবিকা নয়, শিল্পীর ক্যানভাসও। সেই মাটিতেই এখন গড়ে উঠছে রঙিন সাজের এক নতুন অধ্যায়। পোড়ামাটির অলঙ্কার আজ এক অনন্য জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। হার, দুল, টিকলি, বালা, আংটি বা ব্রোচ- সবই এখন পোড়ামাটির নানা নকশায় তৈরি হচ্ছে।

রাজশাহী, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ ও সাভারের কারুশিল্পীরা তৈরি করছেন নান্দনিক সব ডিজাইন- কখনো চাঁদ-তারা, কখনো ফুল-পাখির নকশায়, আবার কখনো ঐতিহ্যবাহী আলপনা বা জ্যামিতিক মোটিফে। লাল, কালো ও সোনালি রঙের টেরাকোটা দুল, পাতার নকশার টিকলি, গোলাপ আকৃতির মাটির আংটি, কিংবা মাটির বলের মালা। এসব গয়না হালকা, অ্যালার্জি-ফ্রি এবং যেকোনো পোশাকের সঙ্গে মানিয়ে যায়।


কাঠের গয়না

কাঠের মধ্যে রয়েছে প্রকৃতির উষ্ণতা ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবেদন। শিসম, বাবলা, নারকেল, মেহগনি, বাঁশ ও আমকাঠ দিয়ে তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন অলঙ্কার- যমন, খোদাই করা নেকলেস, পুঁতির দুল, কাঠের বালা, হেয়ারপিন ও ব্রোচ। তরুণ ডিজাইনাররা এখন কাঠের গয়নায় যোগ করছেন ধাতব বা কাপড়ের মিশ্রণ, ফলে তৈরি হচ্ছে নতুন ধাঁচের ফিউশন স্টাইল।

‘নেচার হুইস্পার’, ‘ট্রিব্যাল টাচ’ বা ‘উড-ক্রাফট মালা’- এসব ব্র্যান্ডেড কাঠের নেকলেস এখন অনেকের পছন্দের তালিকায়। কাঠের গয়নার বিশেষত্ব হলো এটি টেকসই, হালকা ও পরিবেশবান্ধব।


বীজের গয়না

বন, গাছ ও বীজ- প্রকৃতির এই ক্ষুদ্র উপাদানগুলো আজ নতুনভাবে ফিরে এসেছে সাজে। রুদ্রাক্ষ, কুচবীজ, তিসিবীজ, বেলবীজ, বটবীজ বা জামবীজ দিয়ে তৈরি হচ্ছে মালা, দুল, পায়েল, আংটি ও ব্রেসলেট। কুচবীজের মালা, রুদ্রাক্ষের ব্রেসলেট, তিসিবীজের টিকলি কিংবা বটবীজের দুল প্রকৃতির সৌন্দর্য বহন করে। এই গয়নাগুলো হালকা, টেকসই এবং একেবারে প্রাকৃতিক উপকরণে তৈরি- যেখানে ফ্যাশন ও পরিবেশ একসঙ্গে মিলেছে।


কাপড়ের গয়না

বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী বস্ত্র শিল্প এখন অলঙ্কারে রূপ নিচ্ছে। তুলো, সিল্ক, জামদানি, নকশিকাঁথা বা এমনকি পুরনো শাড়ির অংশ দিয়েও তৈরি হচ্ছে অসাধারণ সব গয়না। ফুলের দুল, কাপড়ের বলের মালা, অ্যামব্রয়ডারি করা টিকলি, ফ্যাব্রিক ব্রোচ, চুড়ি এবং হেডব্যান্ড এখন শহুরে নারীদের সাজে অনন্য সংযোজন। নকশিকাঁথার সেলাইয়ে তৈরি টিকলি, জামদানির কাপড়ে দুল, বা ফুলের পাপড়ির মতো ভাঁজ করা ফ্যাব্রিক ব্রেসলেটের বেশ চাহিদা আছে। এই গয়নাগুলো সহজে ধোয়া ও পুনর্ব্যবহারযোগ্য। তাই এগুলো পরিবেশবান্ধব ও আরামদায়ক।


শাঁখা ও সামুদ্রিক খোলের অলঙ্কার

সামুদ্রিক ঝিনুক, শাঁখা ও প্রবাল- এই তিনটি উপাদান শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নারীর সাজে রয়েছে। আজও কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের উপকূলে স্থানীয় কারিগরেরা শাঁখা ও খোল দিয়ে তৈরি করছেন চুড়ি, দুল, প্রবালের মালা, ব্রোচ ও আংটি। সামান্য পালিশ, সামুদ্রিক ছোঁয়া, আর হাতে তৈরি নকশা- সব মিলে এই গয়নাগুলো হয়ে ওঠে গ্রীষ্মকালীন সাজের সেরা উপাদান। বিশেষ করে সমুদ্রভ্রমণ বা উৎসবের সাজে এই ধরনের অলংকার এখন খুবই জনপ্রিয়।


রজন [জবংরহ] ও মোমের গয়না

রজনের [জবংরহ] মধ্যে ফুল, পাতা বা ঝিনুক বন্দি করে তৈরি গয়নাগুলো আজকের তরুণদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে। রজনের দুল, পেনডেন্ট, ব্রেসলেট, আংটি ও হেয়ার ক্লিপ এখন ট্রেন্ডি ফ্যাশন অ্যাক্সেসরি। ফুল বন্দি পেনডেন্ট [চৎবংংবফ ঋষড়বিৎ চবহফধহঃ], গোল্ড লিফ দুল, রজন রঙিন বালা। এর স্বচ্ছতা, হালকাভাব ও স্থায়িত্ব গয়নাটিকে করে তুলছে আধুনিক ও মার্জিত।


তন্তু, দড়ি ও পাটের গয়না : দেশের গর্ব

বাংলাদেশের পাট একসময় ছিল ‘সোনালি আঁশ’- আজ সেই আঁশই ফিরেছে নতুন রূপে। পাট, দড়ি ও তুলা দিয়ে তৈরি হচ্ছে বালা, মালা, দুল, টিকলি ও জুট-ব্রোচ। এই গয়নাগুলো টেকসই, হালকা, এবং দেশীয় গন্ধে ভরা।


ধাতব অলংকার : ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সংমিশ্রণ

ধাতব অলংকার একদিকে রাজকীয়, অন্যদিকে আধুনিক ফ্যাশনের অঙ্গ। সোনা ও রুপার বাইরে এখন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ব্রাস [পিতল], কপার [তামা], ব্রোঞ্জ, নিকেল ও অক্সিডাইজড মেটাল গয়না। এই গয়নাগুলো দীর্ঘস্থায়ী, রেট্রো ও এথনিক লুক দেয়। ঢাকা, রাজশাহী ও কুষ্টিয়ার কারুশিল্পীরা এখন হাতে বানানো মেটাল জুয়েলারিতে যুক্ত করছেন কাঠ, পাথর ও কাপড়ের উপাদান, যা একে আরও সৃজনশীল করে তুলছে। এখন নারীরা সোনার দুল নয়- বরং মাটির দুল, কাঠের মালা বা কাপড়ের টিকলি পরে জানিয়ে দিচ্ছেন তাদের পরিবেশ সচেতনতা, মৌলিকতা এবং স্থানীয় ঐতিহ্যের প্রতি ভালোবাসা। হ

লেখা : ফাতেমা ইয়াসমিন