ময়মনসিংহ জেলার গৌরীপুর উপজেলা সদরে জমিদার বাড়িটি অবস্থিত। উনিশ শতকের প্রথম দিকে ইংরেজ শাসনামলে যুগল কিশোর রায়চৌধুরী এই অঞ্চলে জমিদারি লাভ করেন। জমিদারি লাভের পর বসবাসের জন্য দোতলা বাড়ি, একতলা কাচারি ভবন ও দুর্গামন্দির নির্মাণ করেন।
জমিদার যুগল কিশোর রায়চৌধুরীর মৃত্যুর পর তাঁর বড়ো ছেলে হরিকিশোর রায়চৌধুরী গৌরীপুরের জমিদার হন। হরিকিশোর রায়চৌধুরীর কোনো পুত্রসন্তান না-থাকায় তিনি দত্তক নেন। তার মৃত্যুর পর দত্তকপুত্র আনন্দকিশোর রায়চৌধুরী জমিদারি লাভ করেন। আনন্দকিশোর রায়চৌধুরী উশৃঙ্খল জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। তিনি সারাক্ষণ আনন্দ-ফুর্তিতে মেতে থাকতেন। আনন্দকিশোর রায়চৌধুরীর মৃত্যুর পর তার ছেলে রাজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী জমিদার হন। রাজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ছিলেন শিক্ষানুরাগী। তিনি সংস্কৃতি ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে জমিদারবাড়ির অদূরে প্রতিষ্ঠা করেন ‘রাজেন্দ্রকিশোর হাই স্কুল’। কলেজ-ভবনের সারি সারি কক্ষ, বেলকনি, পিলার এবং কলেজ-ভবনের শীর্ষদেশে নামফলকের পাশের নকশাগুলো খুবই নান্দনিক। কলেজ প্রাঙ্গণের সামনে বিশাল দিঘি রয়েছে। শত বছর প্রাচীন কলেজের বিশাল একতলা ভবনটি ইন্দ-ইউরোপীয় স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত। জমিদার রাজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর পৃষ্ঠপোষকতায় জমিদারবাড়িতে বছরে একাধিকবার ধ্রুপদী নৃত্য ও সংগীতের জলসা হতো। ভারত বর্ষের প্রখ্যাত শিল্পীরা সেই ধ্রুপদী জলসায় অংশ নিতেন।
জমিদার রাজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী নিঃসন্তান ছিলেন। তার মৃত্যুর পর স্ত্রী বিশ্বেশ^রী দেবী জমিদারির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি প্রজাহিতৈষিণী ছিলেন এবং দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। ইংরেজ শাসকরা তার দায়িত্ব পালনে আপত্তি জানালে তিনি দত্তকপুত্র ব্রজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর হাতে জমিদারির দায়িত্ব ছেড়ে দেন। ব্রজেনকিশোর রায়চৌধুরীও দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি জমিদারবাড়ির অদূরে চারদিকে লেক খনন করে মাঝখানে দৃষ্টিনন্দন দ্বীপ সৃষ্টি করে বাগানবাড়ি নির্মাণ করেছেন। ব্রজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী এবং পরবর্তীসময়ে তার ছেলে বীরেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ভারতীয় ধ্রুপদী সংগীত বিকাশে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। জমিদার ব্রজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর পৃষ্ঠপোষকতায় সে সময়ে কলকাতা থেকে ‘সংগীত বিজ্ঞান প্রবেশিকা’ নামে সংগীতবিষয়ক একটি পত্রিকা প্রকাশিত হতো। তার ছেলে বীরেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ভারতীয় শুদ্ধসংগীতের অন্যতম তাত্ত্বিক ছিলেন। তিনি সংগীতবিষয়ক অনেক মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন। এর মধ্যে ‘হিন্দুস্থানী সংগীতে তানসেনের ভূমিকা’, ‘রাগসংগীত’, ‘হিন্দুস্থানী সংগীতের ইতিহাস’ উল্লেখযোগ্য। জমিদার ব্রজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী এবং তার ছেলে বীরেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ভারতীয় ধ্রুপদী সংগীত বিকাশে গৌরবদীপ্ত অধ্যায়ের সূচনা করেছিলেন। সে সময়ে ভারত বর্ষের শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রখ্যাত ওস্তাদ ও শিল্পীদের আগমন গৌরীপুর জনপদকে সমৃদ্ধ করেছিল।

জমিদার বাড়ির প্রবেশমুখেই রয়েছে দৃষ্টিনন্দন কাছারিভবন। উত্তর-দক্ষিণে প্রসারিত লাল রঙের কাছারিভবনে মোট আটটি কক্ষ রয়েছে। প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় ও বিচার-সালিশির জন্য কছারিভবনের কক্ষগুলো ব্যবহার করা হতো।
লালা রঙের কাছারিভবনের মাঝখান দিয়ে গৌরীপুর জমিদারবাড়িতে প্রবেশের প্রধান ফটক ও পথ। ফটকের উপরিভাগে রয়েছে কারুকার্যখচিত গম্বুজ। গম্বুজটির অষ্টভূজ বাঁকানো কার্নিশ খুবই দৃষ্টিনন্দন। ফটকের প্রবেশ পথ ধরে এগিয়ে গেলে প্রথমেই চোখে পড়বে দুইশত বছর প্রাচীন শ্রী শ্রী দুর্গামন্দির। এই মন্দিরটিতে কালীরূপী দুর্গাদেবী অধিষ্ঠিত রয়েছেন। মন্দিরটিতে এখনো নিয়মিত পূজা অনুষ্ঠিত হয়।
গৌরীপুর জমিদারবাড়ির চারদিকে চারটি ভবন রয়েছে। বাড়িটির উত্তর ও পশ্চিম পাশে দু’টি দোতলা ভবন। এই ভবন দু’টিতে অনেক কক্ষ রয়েছে। পশ্চিম পাশের ভবনের সাথে কাছারিভবনের সংযোগ রয়েছে। জনশ্রুতি রয়েছে, পশ্চিম পাশের ভবনে ফাঁসির মঞ্চ ছিল। এই ভবনের অন্যান্য কক্ষগুলোতে জমিদারির দাপ্তরিক কাজ হতো। পূর্ব ও উত্তর দিকের ভবনগুলো অন্দরমহল হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এই দু’টি ভবনে জমিদার পরিবারের সদস্যরা বসবাস করতেন। দক্ষিণ দিকের একতলা ভবনটি জমিদারবাড়ির পাইক পেয়াদাসহ কর্মচারীরা ব্যবহার করতেন।
১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দের ভূমিকম্পে উত্তর ও পশ্চিম পাশের ভবন দু’টির বেশকিছু অংশ মাটির নিচে দেবে যায়। যার কারণে বাকি ভবন দু’টি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। এরপর পূর্ব পাশের একতলা ভবনটিকে কাঠ ও টিন দিয়ে ভূমিকম্প সহনশীল করে দোতলায় রূপান্তরিত করা হয়। টিন ও কাঠের তৈরি নকশাখচিত চৌচালাটির চারদিকে ছিল টানা বারান্দা। দোতলায় ওঠার জন্য উত্তর ও দক্ষিণ পাশে দু’টি কাঠের সিঁড়ি তৈরি করা হয়েছিল। কাঠের তৈরি শতবর্ষী সিঁড়ি দু’টি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়লে দক্ষিণ পাশের সিঁড়ি ভেঙে সেখানে পাকা সিঁড়ি তৈরি করা হয়। আর উত্তর পাশের কাঠের সিঁড়িটি এখনো পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত কাঠের সিঁড়ির রেলিং ও সিঁড়িঘরের কাঠের পাটাতনের অস্তিত্ব এখনো রয়েছে। কালের আবর্তে দোতলার কাঠের চৌচালাটি সৌন্দর্য হারিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে।
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ভারতবর্ষ বিভক্ত হওয়ার পর ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে গৌরীপুর জমিদার পরিবারটি ভরতের কলকাতায় চলে যায়। ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে দীর্ঘ ২৫ বছর অযতœ অবহেলায় পড়েছিল গৌরীপুর জমিদারবাড়ি। অবশেষে ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে জমিদারবাড়িটিতে প্রতিষ্ঠা করা হয় গৌরীপুর মহিলা ডিগ্রি কলেজ। বর্তমানে জমিদারবাড়ির কাঠের দোতলা ভবনটিকে ছাত্রীদের হোস্টেল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ছাত্রীদের থাকার জন্য অপরিকল্পিতভাবে কাঠের দোতলার বৈঠকখানায় ইচ্ছেমতো ছোটো ছোটো কক্ষ বানানো হয়েছে। এই ভবনের নিচতলাটি কলেজের শ্রেণিকক্ষ, শিক্ষক ও অধ্যক্ষের কক্ষসহ কলেজের অফিসকক্ষ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। জমিদার বাড়ির অন্দরমহলে ঢোকার জন্য দক্ষিণ পাশে কাঠের তৈরি মূল ফটকটি দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রাখা হয়েছে। বর্তমানে পূর্ব দিক থেকে কলেজে ঢোকার বিকল্প পথে জমিদারবাড়িতে ঢুকতে হয় ।
গৌরীপুর জমিদারবাড়ি থেকে শত বছরের প্রাচীন অনেক মূল্যবান আসবাবপত্র ও ভাস্কর্য পাওয়া গিয়েছে। এসব জিনিসপত্র ও ভাস্কর্য এখন ময়মনসিংহ শশীলজ জাদুঘরে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ময়মনসিংহ জেলার গৌরীপুর উপজেলার জমিদারবাড়ি বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রত্মতাত্ত্বিক সম্পদ।
লেখক : গবেষক, লেখক ও টেলিভিশন অনুষ্ঠান নির্মাতা